একটু থেমে আবার বললেন—অনেকদিন তাকে দেখিনি, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই তিনি এসে সামনে দাঁড়ান। যাক, একটু জল খেয়ে আবার আসুন, আপনাকে একটা কথা বলবার আছে।
এবার আর অতিথিশালা নয়, পুরনো কাছারিবাড়ির একখানা ঘরে জায়গা পেলাম। রঘু বুড়ো হয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার কর্মদক্ষতা একটুও কমেনি। পশমের আসন পেতে বসিয়ে মর্তমান কলা আর একথাবা সর দিয়ে সে আমাকে পরিতোষ করে জলখাবার খাওয়ালো। সবই ঠিক, কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছিল–কঃগতোত্তরকোশলা?
আবার দেবদর্শনের ঘরে এসে বসলাম। ভদ্রলোক খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন, বেশি ভূমিকা না করে বললেন–ঠাকুরমশাই, সে আবার এসেছিল—
বললাম—কে?
—সেই যে, সে। অমরজীবন। বলে গিয়েছিল আবার দেখা হবে। দেখা হল। এক আশ্চর্য জিনিস সে আমাকে দেখাল। সে কথা বলবার জন্যই আপনাকে ডেকেছি। আর কেউ তো ঠিক বুঝবে না, সময় থাকতে বলে যাই–
—আপনার কষ্ট হবে না? এত কথা বলছেন।
—কিছু হবে না। আপনি আসায় আমি নতুন শক্তি পেয়েছি মনে। শুনুন, গত শুক্রবারের আগের শুক্রবার, মানে দিনদশেক আগে হঠাৎ রঘু এসে উত্তেজিত গলায়। বলল—কর্তা, সেই পাগলমত লোকটাকে মনে আছে? সে কী যেন ছড়া বলে লটারির। টিকিটের নম্বরের হদিশ দিয়েছিল? সে এসেছে–
প্রথমটা খেয়াল করতে পারিনি, মানুষ এমনই অকৃতজ্ঞ জীব। এই কয়েকবছরের ব্যবধান ভুলিয়ে দিয়েছিল তার কথা। তারপর একসঙ্গে সব মনে পড়ে গেল।
বললাম—কোথায় সে?
–দালানে বসিয়ে রেখে এসেছি কর্তা। ডাকব?
—ডাক। নিয়ে আয় এখানে—
যেতে গিয়ে রঘু একটা ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে গেল। বললাম কীরে, কিছু বলবি?
—হ্যাঁ কর্তা। একটা ব্যাপার একটু কেমন যেন লাগছে।
—কী ব্যাপার?
—এই লোকটা এর আগে যে এসেছিল, সে কতদিন আগেকার কথা?
একটু ভেবে বললাম—তা, বছর বারো-চোদ্দ হবে। কেন রে?
–কর্তা, এই সময়ের ভেতর আমরা তো সব বুড়ো হয়ে গেলাম, চুল-দাড়ি পেকে গেল, চামড়া কুঁচকে গেল। এই লোকটার চেহারা কিন্তু একদম বদলায় নি, একেবারে সেইরকম আছে। এ আবার কী ব্যাপার কর্তা?
বললাম—তাই? আচ্ছা, আগে নিয়ে তো আয় দেখি।
একটু পরেই রঘুর পেছন পেছন অমরজীবন এসে ঘরে ঢুকল।
আশ্চর্য! রঘু একটুও বাড়িয়ে বলেনি, এ তো অবিকল সেই বারো বছর আগে দেখা মানুষটা। বরং যেন আরো তরুণ আর সতেজ হয়েছে তার চেহারা। এ কী করে হয়!
সে এগিয়ে এসে খাটের ধারে দাঁড়িয়ে বলল—মুখুজ্জেমশাই বলেছিলাম আসব? এলাম।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই একটুও চেহারা বদলায়নি তার। এমন কী করে হতে পারে আমি ভেবে পেলাম না।
সে বলল—বসি একটু আপনার পাশে?
আগের বার কী সম্বোধন করেছিলাম তা ঠিকঠাক মনে পড়ল না।
এখন আমার বয়েস অনেক বেড়ে গিয়েছে, কিন্তু কোন অলৌকিক উপায়ে অমরজীবন আটকে আছে চল্লিশের কোটাতেই। কাজেই কোন সঙ্কোচ না করে বললাম—বোস। তারপর এতদিন পরে হঠাৎ?
সে বলল–আসবার সময় হয়েছিল তাই এলাম! আপনার সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে। কিংবা এইভাবেও বলা যেতে পারে—আপনারও দরকার আছে আমাকে। কিন্তু সে তো আজকে হবে না, কাল সকালে হবে।
কিছুই বুঝতে পারলাম না, তবু বললাম—কেন? আজ হবে না কেন?
—আজ রাত্তিরে আমি স্বপ্ন দেখব, কালকের দরকারটা একটু গুছিয়ে নেব কিনা। আপনার দরকারটা কী তা ভাল করে জেনে নিতে হবে।
গতবার যখন এসেছিল অমরজীবন, তখনও এইরকম নানা পাগলাটে কথা বলেছিল। কিন্তু তার কথা অনুযায়ী আমি তো লটারির প্রাইজ পেয়েছিলাম, তাই না? তার কথাবার্তা শুনতে অদ্ভুত লাগলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বললাম— বেশ তো, থাকো।
–আমাকে কেবল রাত্তিরে শোবার জন্য একটু জায়গা দেবেন। খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না, স্বপ্ন দেখার রাত্তিরে আমি কিছু খাই না।
যাই হোক, পরের দিন সকালে অমরজীবন আমার বিছানার পাশে এসে বসল। আমি কিছু বলবার আগেই বলল আপনার কী চাই সেটা স্বপ্নে জানতে পারলাম!
বললাম—কী সেটা?
—এমন কেউ আছে যাকে আপনার খুব দেখতে ইচ্ছা করে? অনেকদিন দেখেনি নি এমন কেউ?
আজ কয়েকদিন হল বাবাকে খুব মনে পড়ছে। সেই কবে মারা গিয়েছেন বাবা। আমার কৈশোরে। কী ভালই না বাসতেন আমাকে! তাঁর চরিত্রে উচ্ছ্বাসের বাড়াবাড়ি ছিল না, শুধু কাছে গিয়ে বসলে বুকের উষ্ণতাটুকু টের পেতাম। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বলেছিলেন পশ্চিমের মাঠে কোথায় নাকি তেঁতুলগাছের ডালে কী এক অদ্ভুত পাখি বাসা করেছে। সবাই দেখতে যাচ্ছে, কিন্তু কেউই বুঝতে পারছে না কী পাখি। আমাকে দেখাতে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন। যাওয়া হয়নি। তার আগেই বাবা অসুখে পড়লেন এবং সে অসুখ থেকে আর উঠলেন না। বয়স হলে মানুষের কেবলই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সে কথা আমি অমরজীবনকে বললাম না। দেখি ও কী করে।
অমরজীবন বলল—মুখুজ্জেমশাই, আমি জানি। আচ্ছা, আপনি একবার একটু চোখ বুজুন তো। এক থেকে পাঁচ গুনতে যতক্ষণ সময় লাগে, তারপর আবার তাকান। বন্ধ করুন চোখ।
আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে এক থেকে ধীরে ধীরে পাঁচ অবধি গুনলাম। তারপর তাকালাম।
অমরজীবন যেখানে বসেছিল, বিছানার পাশে সেই জায়গাটায় আমার বাবা বসে আছেন!
এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল আমার হৃদপিণ্ড বুঝি থেমে যাবে। মায়া নয়। মতিভ্রম নয়। সত্যি সত্যিই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বাবা। এমনকি তার কপালের বাঁদিকের রগটাও টিটি করতে দেখলাম, যেমনটি জীবদ্দশায় বাবার করত।