—কেন, গিন্নীমা?
—তিনি নেই।
আমি মৃত্যু অনেক দেখেছি, অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছি, শব সাধনা করেছি—মন আমার শক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুখুজ্জেগিন্নীর মৃত্যুসংবাদ শুনে। বুকের ভিতরটা কষ্টে মুচড়ে উঠল। মনে পড়ে গেল খেতে বসে সেই মুখ তুলে হঠাৎ গিন্নীমাকে দেখে ফেলা। সেই পদ্মপলাশের মত চোখ, চওড়া লালপাড় শাড়ি, মন্দিরের দরজার সামনে সেই লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। তিনি চলে গিয়েছেন, তাই বুঝি এ বাড়ির ঘরদোর, দেউড়িতে, সমস্ত পরিবেশে বিষণ্ণতার ছায়া।
বললাম—তুমি তো অনেক বুড়ো হয়ে গেছ রঘু। তোমার গালে ও কীসের কাটা দাগ?
রঘু বলল—তা তো বুড়ো হয়েছি ঠাকুরমশাই, বয়স তো কম হল না। ও দাগটা হল কী, দা দিয়ে একটা বাঁশ চেঁছে খুঁটি বানাচ্ছিলাম—হঠাৎ হাত ফসূকে বাঁশটা গালের ওপর এসে পড়েছিল। বেশি লাগেনি। কিন্তু দাগটা থেকে গেল। সে যাক ঠাকুরমশাই, আমার এখন ভগবানের কাছে শুধু এইটুকু কামনা কর্তা কষ্ট না পেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যান। পেছন পেছন আমিও যাই। আমার আগে গেলে চলবে না ঠাকুরমশাই। কর্তাকে দেখার আর কেউ নেই।
কথা বলতে বলতে রঘু হাত তুলে চোখের জল মুছল। ঠিক স্বপ্নে যেমনটি দেখেছিলাম, সেই দৃশ্য। আমি জয়তলা ছেড়ে চলে যাওয়ার অনেক পরে রঘুর গালের ওই কাটা দাগ হয়েছে, অথচ তা আমি স্বপ্নে স্পষ্ট দেখেছি। তার এই হাত তুলে চোখ মোছর ছোট্ট ঘটনাটা।
বললাম—চল রঘু, মুখুজ্জেমশাইয়ের কাছে যাই।
রঘু আমাকে নিয়ে চলল ভেতরবাড়িতে। সেই দেউড়ি, সেই বারান্দা—যেখানে বসে আমরা খেতাম। দালান পার হয়ে ভেতর বাড়ি। এর আগে জয়তলা থাকার সময়েও একেবারে অন্দর মহলে কখনও ঢুকিনি। চওড়া বারান্দা পার হয়ে বাঁদিকের একটা বড়ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অনুচ্চ গলায় রঘু ডাকল—কর্তা, কর্তা—
কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে ক্লান্ত, স্তিমিত গলায় কথা ভেসে এল—কে?
–কর্তা, ঠাকুরমশাই এসেছেন। সেই যে, সেই ঠাকুরমশাই–
–ভেতরে নিয়ে আয়।
ঘরে ঢুকলাম। প্রায় কোমর ছাড়িয়ে উঁচু বিশাল খাটে দেবদর্শন শুয়ে আছেন। কাছে এগিয়ে গিয়ে তার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে বললাম—কী মুখুজ্জে মশাই, চিনতে পারেন?
—পারি। কেমন আছেন আপনি?
—আমি তো ভাল আছি। আপনি আবার অসুখ বাধিয়ে বসলেন কেন? সেরে উঠুন। দেখি চটপট করে।
দেবদর্শনের চেহারা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। শরীর প্রায় অর্ধেক, বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। গায়ের রঙ মলিন হয়ে গিয়েছে। অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে তার। কিন্তু। একটি জিনিস মহাকাল হরণ করে নিতে পারেনি। সেটি হচ্ছে তার চোখ। বড় বড় উজ্জ্বল দুই চোখের দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ করে তিনি বললেন—সবই তো বুঝতে পারছেন। ঠাকুরমশাই। এবার সংসার গুটিয়ে নেবার সময় হল। আর সংসারই বা কোথায়? এ. বাড়ির গিন্নীমা চলে গিয়েছেন রঘু বলে দিয়েছে বোধহয়। ছেলেরাও নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। সেটাই স্বাভাবিক। বড় একা হয়ে গেছি ঠাকুরমশাই-একা থাকা বড় কষ্টের।
একটা জিনিস দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। দেবদর্শনের খাড়া বাঁশির মত নাক ঈষৎ বেঁকে আছে। অসুস্থ শয্যাশায়ী রোগীর নাক বেঁকে গেলে সে আর বেশিদিন বাঁচে না। তাছাড়া ঘরে ঢুকেই আমি মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছি। তোমাদের তো আগেই বলেছি এটা আমি পাই, এবং আমার এই পূর্বধারণা আজ পর্যন্ত কখনও ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়নি।
ক্ষীণস্বরে দেবদর্শন আবার বললেন—বসুন ঠাকুরমশাই, আমার এই বিছানার পাশেই বসুন। রঘু, তুই যা-ঠাকুরমশাইয়ের জন্য জলখাবারের ব্যবস্থা কর।
রঘু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন—শুনতে পেয়েছেন তাহলে?
বললাম-তা পেয়েছি? নইলে এলাম কেন?
—আপনাকে কষ্ট দিলাম ঠাকুরমশাই, কিন্তু আমার কোন উপায় ছিল না। আপনাকে আর একবার না দেখে আমি শান্তিতে মরতে পারতাম না। কী যে সম্পর্ক আপনি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন! যেদিন নিশ্চিত করে বুঝতে পারলাম এবারে আর বিছানা ছেড়ে উঠবো না সেদিনই দুপুরবেলা শুয়ে শুয়েই মধুসুন্দরীদেবীর শ্লোক উচ্চারণ করে মনে মনে আপনাকে ডাকলাম।
—সঙ্গে সঙ্গেই আমি আপনার ডাক শুনতে পেয়েছি। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি। কিন্তু সেদিন রাত্তিরেই এই বাড়ি আর রঘুকে স্বপ্নে দেখলাম। সময় নষ্ট করিনি মুখুজ্জে মশাই, আমি বুঝতে পেরেছিলাম হাতে বেশি সময় নেই। তাই তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে পড়েছি।
দেবদর্শন রোগা, শীর্ণ মুখে ক্লিষ্ট হাসি হাসলেন। তার চোখের দৃষ্টির মত হাসিটুকু এখনও অম্লান আছে। তিনি বললেন—খুব ভালো করেছেন। সময় যে আর নেই সে আমিও বুঝতে পেরেছি। আমি কবে যাবো ঠাকুরমশাই?
বললাম—এখনো কিছু দেরি আছে, সম্ভবত সামনের মাসের শুক্লপক্ষের কোনো দিন। অন্য কেউ হলে বলতাম না, কিন্তু এই ভবিষ্যদ্বাণী শোনবার যোগ্যতা আপনি লাভ করেছেন। মনকে মুক্ত করে দিন, নিয়ত ইষ্টচিন্তা করুন।
দেবদর্শন বললেন—মন আমার মুক্তই আছে। সেই কবে হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ মাতৃগর্ভ থেকে উলঙ্গ ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম, আবার অগ্নিশুদ্ধি করে নিজেকে ফিরিয়ে দেব ঈশ্বরের হাতে। এপারের যা কিছু সঞ্চয় তা এপারেই থেকে যাবে। বরং এখন তো ওপারটাই বেশি টানে। না, ধর্মকর্ম বা ওইরকম অর্থে বলছি না। মনে হয় এবাড়ির সেই মানুষটি অপেক্ষা। করে রয়েছেন ওপারে—আমার জন্য। তার কাছেই তো যাচ্ছি, তাহলে আর ভয় কী?