বললাম—আপনি কষ্ট করলেন কেন? চারি নেই?
তারানাথের মুখে বিষণ্ণতার ছায়া পড়ল। সন্তান বড় মায়ার জিনিস। কন্যাকে বিবাহ দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হয় এ তো চিরকালের সত্য। ভালো ঘরে চারির বিয়ে হয়েছে। সে সুখে আছে। তার খোকাটিও হয়েছে নাদুন-নুদুস, বড় বড় ঝকঝকে চোখ। তারানাথের তো এসব নিয়ে সুখেই থাকা উচিৎ। কিন্তু প্রতিবারই মেয়ে চলে গেলে সে বেশ কয়েকদিন মুখ গম্ভীর করে থাকে। বিশেষ করে নাতিটি হবার পর তার এই দশা।
তারানাথ বলল—না, চারি গতকাল শ্বশুরবাড়ি ফিরে গিয়েছে। জামাই এসেছিল নিতে।
আমি বললাম—মন খারাপ করবেন না, এই তো সামনেই পূজো, পূজোয় তো আবার তারা আসবে। এখন বরং জমিয়ে একটা গল্প বলুন আমাদের। মনের ভার কেটে যাবে।
তারানাথ বলল-জয়তলা গ্রামের দেবদর্শন মুখুজ্যের গল্পটা তখন শেষ করা হয়নি। সেটাই আজ বরং বলি। তারপর আবার নতুন পর্বে নতুন গল্প শুরু করা যাবে। শেষ হবে না, বুঝেছ? গল্পের প্রবাহ বইছে জীবনে–
সিগারেট ধরিয়ে তারানাথ বলতে শুরু করল।
–জয়তলা গ্রাম থেকে তো বিদায় নিয়ে চলে এলাম। বড় ভাল লেগেছিল মুখুজ্জেবাড়ির আতিথ্য, স্বয়ং মুখুজ্জেমশাইকে। বেশ কিছুদিন তাদের কথা প্রায়ই মনে পড়ত। তারপরে যা হয়, একটামাত্র জিনিস নিয়ে মানুষের মন ব্যাপৃত থাকতে পারে না। ধীরে ধীরে অন্য সাম্প্রতিক ঘটনা এসে সে জায়গা দখল করল। কত জায়গায় বেড়িয়ে বেড়ালাম, কত অদ্ভুত চরিত্র দেখলাম। বছর কেটে গেল অনেক।
একদিন ঘরের ভেতর বসে কোষ্ঠী তৈরি করছি, সময়টা সকাল দশটা মত হবে, বাইরে থেকে কে যেন ডাকল—ঠাকুরমশাই।
বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখলাম কেউ কোথাও নেই। সে আবার কী! স্পষ্ট ডাকটা শুনলাম, কী রকম হল ব্যাপারটা।
অবাক হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের মধ্যে ফিরে এসে বসতে না বসতেই আবার সেই ডাক–ঠাকুরমশাই।
এবার আর বাইরে বেরোলাম না। আমি বুঝতে পেরে গিয়েছি বেরিয়ে কাউকে দেখতে পাবো না। তার চেয়ে বড় কথা, যে ডাকছে তার গলার স্বরটা আমার খুব চেনা, যদিও সে সময় কিছুতেই ঠিক করতে পারলাম না কার গলা সেটা।
সেদিন রাত্তিরে শুয়ে স্বপ্ন দেখলাম আমি যেন আবার জয়তলা গ্রামে গিয়েছি। রঘু ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করছে—আরে! ঠাকুরমশাই যে! আসুন, আসুন–
রঘুর চুল আর গোঁফ প্রায় সবই পেকে গিয়েছে। বাঁ গালে একটা লম্বা কাটা দাগ। এটা তো আগে দেখিনি।
আরো কী যেন সব বলতে লাগল রঘু। তার ঠোট নড়ছে, কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে সে কী বলছে তা আমি বুঝতে পারছি না। সেকালের সাইলেন্ট ছবির মত। কথা বলতে বলতে রঘু একবার হাত তুলে চোখ মুছল। কী বলছে রঘু?
ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসলাম। ঝিমঝিম করছে নিশুতি রাত। ততক্ষণে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। আমি বুঝতে পেরেছি সেদিন কার গলা আমি শুনেছিলাম।
দেবদর্শন মুখুজ্জে আমাকে ডাকছেন। জয়তলা থেকে চলে আসবার সময় ওঁকে বলে এসেছিলাম কোন কারণে আমাকে দরকার হলে কী করে ডাকতে হবে। সে কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এত বছর পরে আমাকে কেন ডাকছেন দেবদর্শন? যে কারণেই ডাকুন না কেন, তার মধ্যে একটা অসহায় আকুতি ফুটে উঠেছিল।
পরের দিন একটা ঝুলিতে দু-চারটে জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে জয়তলায় রওনা হয়ে গেলাম। মাঝখানে অনেক সময় কেটেছে বটে, কিন্তু জয়তলা পৌঁছতে হলে এখনো শেষ চার মাইল মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হয়। সুন্দর রোদে ভরা এক বিকেলে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তার ওপর বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছে গেলাম দেবদর্শনের গ্রামে। প্রায় বারো-তেরো বছর পরে এখানে এলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এই সেদিন গিয়েছি এখান থেকে। ভালোও লাগছিল, আবার আশঙ্কাও হচ্ছিল। কে জানে কেন ডেকেছেন দেবদর্শন। যাক, এখুনি তো জানতে পারবো।
মুখুজ্জে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ বাড়ি আগেও পুরনোই ছিল বটে, কিন্তু তার ভেতর একটা আভিজাত্যভরা গৌরব ছিল। সে জিনিষটা যেন একদম চলে গিয়েছে। রোয়াকে ওঠবার সিঁড়িগুলো বহু জায়গায় ভাঙা। যেখানে দেবদর্শনের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল, সেই দালানের পঙ্খের কাজের চটা উঠে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, দালানের কড়িবরগার ফাঁক থেকে পায়রার দল উধাও হয়েছে। ফলে দালানে একধরনের বিচিত্র নীরবতা বিরাজ করছে। পায়রার দল চলে যাওয়া কোন গৃহের পক্ষে শুভ লক্ষণ নয়।
আর একটা কী যেন এ বাড়িতে ঘটেছে। খুব খারাপ কিছু।
দালানে ওঠবার সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কাকে ডাকা যায়, দেবদর্শনের ছেলেদের নামও ঠিকঠাক মনে পড়ছে না। এমন সময় ভেতর বাড়ি থেকে রঘু বেরিয়ে এসে আমাকে দেখে একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেল।
–আরে! ঠাকুরমশাই যে! আসুন, আসুন—
একেবারে স্বপ্নের সেই সংলাপ হুবহু।
খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছে রঘু। চুল, ভুরু, গোঁফসব পাকা। কপালে আর মুখে জরার কুঞ্চন। তার বাঁ-গালে স্বপ্নে যেমন দেখেছি ঠিক তেমন একটা কাটা দাগ। আসলে ভবিষ্যতের এই দৃশ্যটা স্বপ্নের মধ্যে আমার মনের পটে প্রতিফলিত হয়েছিল।
বললাম–কেমন আছ রঘু? এখানকার সব খবর ভালো তো?
রঘু বলল—না ঠাকুরমশাই, খবর ভালো না।
—কেন, কী হয়েছে?
রঘুর বিশ্বস্ত, প্রবীণ চোখে বেদনা ঘনিয়ে এল। সে বলল—কর্তার খুব অসুখ। আজ মাসখানেক বিছানা থেকেও উঠতে পারছেন না। গত বছরেও একবার শরীর অসুস্থ হয়েছিল। ব্রজমাধব কবিরাজের চিকিৎসায় সেরে উঠেছিলেন। কর্তা তো ইংরিজি ওষুধ খান না। কিন্তু এবারে অবস্থা খুবই কঠিন। সেবা করবার ভালো লোক না থাকলে রোগী সারে না—