—আমি নিশ্চিত।
—কোনোমতেই তার পক্ষে বিহারের জঙ্গলে উপস্থিত হওয়া সম্ভব ছিল না?
–ন্যায়শাস্ত্রের তকমতে হয়ত অসম্ভব বলা যাবে না। কিন্তু কার্যত সম্ভব ছিল না।
বন্ধুটি বলল—তাহলে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তুমি ভুল দেখেছ। কারণ তোমার কথা বিশ্বাস করতে হলে বিজ্ঞানের একটা মূল সূত্রকে অগ্রাহ্য করতে হয়—
বললাম—কী সেটা?
—একই বস্তু একই সঙ্গে দু-জায়গায় থাকতে পারে না। থিওসফির ভাষায় একে বলে বাইলোকেশন। বিজ্ঞানে তা অসম্ভব।
—আমাদের দেশে অনেক মহাপুরুষকে কিন্তু একই সঙ্গে দু-জায়গায় দেখা গিয়েছে। অজস্র মানুষের সমানে যখন আশ্রমে বক্তৃতা করেছেন, একই সময়ে উপস্থিত রয়েছেন মৃত্যুশয্যাশায়ী গুরুভাইয়ের পাশে। এর বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে।
বন্ধু বলল—ভাই, আমি তোমার কথার সমর্থন বা বিরোধীতা কিছুই করছি না। আমি শুধু বলছি—বিজ্ঞান এ কথা মানবে না।
বললাম—বিজ্ঞানের যুক্তিই কি সব? তার বাইরে কি কিছুই নেই?
—থাকতে পারে, কিন্তু আমার জানা নেই। কারণ সেক্ষেত্রে এ আলোচনা যুক্তির সীমা পার হয়ে বিশ্বাসের রাজ্যে পৌঁছবে। আমি বিজ্ঞানী, বিশ্বাস নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার নেই। মোট কথা, আমার মতে বাইলোকেশন সম্ভব নয়।
তারানাথকেও এ বিষয়ে বেশ চেপে ধরেছিলাম। কিন্তু সে কায়দা করে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। কোলকাতায় ফিরে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম— রামরেখার জঙ্গলে ঐ দুর্যোগের রাত্তিরে আপনি কী করে হাজির হলেন বলুন তো?
তারানাথ উত্তর না দিয়ে সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
—আমার বৈজ্ঞানিক বন্ধু বলেছে বাইললাকেশন—মানে, একই বস্তু বা মানুষের একই সঙ্গে দু-জায়গায় অবস্থিতি সম্ভব নয়।
তারানাথ সিগারেটে টান দিয়ে নিস্পৃহ গলায় বলল—ও।
তারানাথের সামান্য ব্যঙ্গমিশ্রিত উপেক্ষার জন্য রাগ করতে পারলাম না। কারণ বিজ্ঞানী বন্ধু যাই বলুক না কেন, ঘটনাটা তো আমি নিজের চোখে দেখেছি।
দেখলাম তারানাথ ভেতরের কথা ভাঙবে না। বললাম—আজ একটু গল্প হবে না? অনেকদিন পরে এলাম—
তারানাথ বলল—আজ এসো আমরা এমনি কথাবার্তা বলি। কিশোরী আসেনি। আজ গল্প জমবে না।
কথাটা ঠিক। কিশোরী না থাকলে আমারও একা গল্প শুনতে ভালো লাগবে না। বললাম–ঠিক আছে, তাই হোক।
একটু বাদে তারানাথের মেয়ে চারি ভেতর থেকে আমাদের জন্য চা নিয়ে এল। তার ভাল নাম বোধহয় চারুলতা বা চারুপ্রভা ওইরকম কিছু। অনেক ছোটবেলা থেকে তাকে দেখছি। আমাদের সামনে সে লজ্জা করে না। চা নামিয়ে রেখে সে হেসে বলল—ভাল আছেন কাকাবাবু? অনেকদিন পরে আপনাকে দেখলাম–
—আমরা তো নিয়মিত তোর বাবার কাছে গল্প শুনতে আসি, তুই বিয়ে হয়ে অবধি আমাদের ভুলে গেলি—তার কি হবে?
দু-তিনবছর আগে চারির বিয়ে হয়েছে। জামাই মানুষটি ভাল, সেদিক দিয়ে তারানাথ সুখী। সম্প্রতি চারির একটি খোকাও হয়েছে, তাকে কোলে করে একবার দেখিয়ে নিয়ে গেল চারি। ভারি ফুটফুটে খোকা।
এটা ওটা গল্প করে চা খেয়ে সেদিন বিদায় নিলাম।
পরের রবিবার দুপুরে খেয়ে ওঠবার একটু পরেই কিশোরী সেন এসে হাজির।
—চল হে, আজ আর দেরি নয়, তারানাথকে চেপে ধরি গিয়ে।
একটা জামা গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। বললাম—এটুকুর জন্য আর ট্রামে চেপে লাভ নেই, চল হেঁটেই মেরে দিই–
রামরেখা পাহাড়ের অভিজ্ঞতা ফিরে এসে কিশোরীকে বলেছি। এ ধরনের কাহিনী কারুকে বলার বিপদ হল বক্তার উপহাসের পাত্র হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কিশোরী
এবং আমিও-প্রথম শ্রেণীর গল্পখোর। গল্প যদি ভাল হয় তাহলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠে না। সমস্ত গল্পটা তাকে বলতে দু-দিন সময় লেগেছিল। শোনার পর সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল—এ কাহিনী বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কারণ যদিও তুমি ইদানিং তারানাথের কিছু গল্প লিখে পাঠকদের চমকাবার চেষ্টা করছ, তবুও এ রকম প্রথম শ্রেণীর গল্প বানাবার ক্ষমতা তোমার নেই। তাহলে তো একটা বড়মাপের লেখক হয়ে যেতে–
বাঁকা চোখে কিশোরীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে খুব সরল মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভারি ইয়ে তোক কিশোরী।
মাসের প্রথম। কাজেই এক প্যাকেট পাসিং শশা, তেলেভাজা এবং একঠোঙা জিলিপি নিয়ে তারানাথের বাড়ি হাজির হলাম। আমাদের দেখে সে খুশি হয়ে বলল-আরে, এস, এস, তোমাদের কথাই ভাবছিলাম। তবে এত তাড়াতাড়ি আসবে বুঝতে পারিনি–
কিশোরী বলল—একটু অসময় হয়ে গেল, না? অনেকদিন গল্পের আসর তেমন করে জমেনি, আজ আর দেরি সইছিল না—
-না, অসময় আবার কী? এত সকাল সকাল তেলেভাজা পেলে কোথায়? বাঃ, এ যে দেখছি বেশ গরম রয়েছে! নাও, শুরু কর। ভেতরে চা বলে আসি–
মট্ লেনের মোড়ে উড়িয়া তেলেভাজাওয়ালা গরম ভাজার ওপরে ভারি সুগন্ধি একধরনের মশলা ছড়িয়ে দেয়। বোধহয় এই জন্যেই তার দোকানে অত ভিড়। লোকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কেনে। কড়াই থেকে নামতে না নামতে বিক্রি হয়ে যায়। তারনাথের,ভাষায় ভোলা থেকে নোলা। তেলেভাজা চিবোনো চলছে, এমন সময়ে বাড়ির ভেতরে যাবার দরজার কড়া নড়ে উঠল। তারানাথ হেসে বলল—ওই চা এসেছে।
সে উঠে গিয়ে পেতলের থালায় সাজানো তিনকাপ চা নিয়ে এল। আমাদের সামনে। খাটের ওপর নামিয়ে রেখে হেসে বলল–তোমাদের বউদিদি এখনও একেবারেই সেকেলে মানুষ। শেকল নেড়ে জানান দেয়।