লিখতে লিখতেই মেজকর্তা বললেন—তা করল বটে, কিন্তু এখানে আমরা কাজ করব না, বুঝলেন? তারই রিপোর্ট লিখছি।
বললাম—সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন?
—সিদ্ধান্ত নেবে কোম্পানি, আমি আমার মতামত জানাচ্ছি মাত্র। রিপোর্টে কী লেখা হচ্ছে জিজ্ঞাসা করতে খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আমি অধস্তন কর্মচারী, ওপরওয়ালার রিপোর্টের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে প্রশ্ন করার অধিকার আমার নেই। মেজকর্তা কিন্তু নিজেই বললেন—এখানকার সব অভিজ্ঞতার কথা লেখা যাবে না, লিখলাম এখানে জলের অসুবিধা, নদী আর ঝরনা প্রায়ই শুকিয়ে যায়, কাজের জন্য কুলি পাওয়া কঠিন—কথায় কথায় তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়। ওইসঙ্গে জায়গাটার ভূপ্রকৃতির অসুবিধার কথা কিছু নির্মলবাবু ঢুকিয়ে দেবেন, যাতে রিপোর্ট বেশ মজবুত হয়। মোট কথা কাজ এখানে করা যাবে না।
সার্ভেয়ার সাহেব কী বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁবুর ঠিক বাইরে দ্রুত ধাবমান পায়ের শব্দ শোনা গেল। পরমুহূর্তেই বিশুয়া আর ডহরু লোহার একসঙ্গে তাঁবুতে ঢুকে হাঁপাতে লাগল। তাদের চোখমুখ রীতিমত উত্তেজিত দেখাচ্ছে।
মেজকর্তা বললেন কী হয়েছে? এত দৌড়োদৌড়ি কীসের?
বিশুয়া বলল—জিপ স্টার্ট নিয়ে নিয়েছে!
ডহরু বলল—বড় পাথরটা আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে।
দুটোই জবর খবর। মেজকর্তা দাঁড়িয়ে উঠে বললেন— জিপ স্টার্ট নিয়েছে সেটা খুব ভাল খবর, কিন্তু তাতে আমি অবাক হচ্ছি না। যন্ত্রপাতি মাঝে মধ্যে এরকম অদ্ভুত আচরণ করে থাকে। তবে পাথরটা ফিরে এসে থাকলে—আচ্ছা, চল, দেখি গিয়ে ব্যাপারটা–
জলধর পণ্ডাও খবর পেয়ে আমাদের সঙ্গে এসে জুটল। আমরা দল বেঁধে চললাম পাথর দেখতে।
সত্যিই অবাক কাণ্ড। মাটির ওপরে যে ঘসটানো দাগ তৈরি করে সরে গিয়েছিল পাথরটা, আবার সেই দাগ বরাবর আগের জায়গায় ফিরে এসেছে!
বিপুলকায় জগদ্দল পাথর। কে এমন অনায়াসে খেলা করছে এটাকে নিয়ে?
মেজকর্তা বললেন কী জলধর, তুমি তো অভিজ্ঞ লোক, তোমার কী মনে হয়?
জলধর হাতজোড় করে বলল—আমার কিছু মনে হয় না কর্তা। কর্তা, চলুন আজই। আমরা এখান থেকে চলে যাই। ডহরু ঠাণ্ডা মাথার লোক, তারও অবস্থা দেখুন–
সত্যিই, বিপদে অবিচল ডহরু লোহারেরও মুখ শুকিয়ে গিয়েছে।
নির্মলবাবু বললেন—আজ বিকেলের মধ্যে তুমি রওনা হতে পারবে?
—নিশ্চয় পারব কর্তা। সিমডেগা যাবার সময় প্রায় সবকিছুই গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। এ ক-টা তবু ভাঙতে আর কতটুকু সময় লাগবে?
তাই ঠিক হল শেষ পর্যন্ত। নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে আমাদের বেশিক্ষণ লাগল না। সব ঠিকঠাক করে আমরা খেতে বসলাম, খেয়ে উঠে পনেরো মিনিট বিশ্রাম করে রওনা দেওয়া যাবে।
খেতে খেতে মেজকর্তা বললেন—এই পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যেই অন্য কোথাও আবার আমাদের জায়গা খুঁজে নিতে হবে কারখানার জন্য। অসুবিধার জন্য জায়গা বদলাচ্ছি। কাজ বন্ধ করছি না–
হঠাৎ তিনি থেমে গিয়ে বললেন সেই লোকটা কোথায় গেল? মৃত্যুঞ্জয়? সে খেতে বসল না আমাদের সঙ্গে?
আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। সত্যিই তো! কোথায় গেল মৃত্যুঞ্জয়? তাকে তো দেখছি না।
অসিতবাবু বললেন-বোধহয় সে আলাদা খেতে বসেছে ডহরুদের সঙ্গে। যাবে আর কোথায়–
কিন্তু ডহরু তখনও খেতে বসেনি, জলধর আর বিশুয়াদের খেতে দিয়ে সে পরিবেশন করছিল। ডিমের ঝোল দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে আসতেই মেজকর্তা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন—ডহরু, মৃত্যুঞ্জয়কে খেতে দিয়েছ তো? ঐ যে, ঐ নতুন লোকটা–
—না বাবু। সে তত খেতে বসেনি। বনের মধ্যে বেড়াচ্ছে হয়তো। এরা উঠুক, সে ফিরে এলে আমি তার সঙ্গে বসবো।
, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় আর ফিরে এল না। সে যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হল, অনেক দেরি হয়ে গেল আমাদের রওনা দিতে, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়কে পাওয়া গেল না। যেমন রহস্যময় তার আবির্ভাব, তেমনই রহস্যময় তার অন্তর্ধান।
সিমডেগার দিকে যখন আমাদের লরি আর জীপ ছাড়ল, বনের ফাঁকে ফাঁকে তখন ঝিকিমিকি বেলা। যেন কার নির্দেশে আকাশ থেকে দুর্যোগের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে গিয়ে বেশ ঝকঝকে নীল বেরিয়ে গিয়েছে। ভিজে মাটি এরই মধ্যে শুকিয়ে উঠেছে অনেকখানি। যে কোন জায়গায় কিছুদিন বসবাস করলে, এমন কি সেখানে অনেক দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে থাকলেও, সে জায়গাটা ছেড়ে চলে আসবার সময় মন কেমন করে। জিপ ছেড়ে দেওয়ার পর পেছন ফিরে শেষবার তাকিয়ে দেখলাম আমাদের কদিনের অস্থায়ী ঘর-গেরস্থালি।
জয় দেবতা পাসাং মারা! তুমি থাকো, আমরা চললাম।
২২. সেই আশ্চর্য পাখি
একটা ঘটনা চলাকালীন তার প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় না। সিমডেগা শহর আর রামরেখা পাহাড়ের জঙ্গলে থাকার সময়ে যে আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল তা যে কোনো মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে দেবার মত। কিন্তু তখন যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে চলেছিলাম, ঘটনার প্রবাহ আমার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে, শেকড় উপড়ে ফেলে দিতে পারেনি। তবে একেবারে ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে গিয়েছে। এখন কোলকাতা ফিরে বুঝতে পারি কী অদ্ভুত অভিজ্ঞতাই না হল! এই যে এই খাতায় এসব কথা লিখে রেখে যাচ্ছি, ভবিষ্যতে এ বিবরণ পড়ে কেউ বিশ্বাস করবে কি? যা আমার কাজ আমি করি।
আমার এক বন্ধু বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে, তার কাছে জঙ্গলের ভেতর তারানাথের আবির্ভাবের গল্পটা করেছিলাম—অবশ্য নাম না করে, বন্ধুটি গল্প শুনে একটু ভেবে বলল–তুমি নিশ্চিত যে, এই ভদ্রলোক তখন কোলকাতায় ছিলেন?