সবই বুঝলাম, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় বিরাট ধাঁধা ধরিয়ে দিল। এরপর থেকে মাটিতে অত্যন্ত নিরীহ আর স্বাভাবিক গর্ত দেখলেও মনে হবে এইখান দিয়ে পাসাং মারার ছায়া-জগতের অনুচর মাটির তলায় প্রবেশ করেছে। বললাম—কিন্তু বিশুয়ার যে অনেকখানি সময় হারিয়ে গেল, তার কী হবে?
মৃত্যুঞ্জয় বলল—সময় হারায় না, তার চলার একটা নিত্য ছন্দ আছে। বিশুয়ার ব্যক্তিগত সময়টা একটু ধীর করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে অন্য সবার সময় যতটা কেটেছে, বিশুয়ার ততটা কাটেনি। একে কালস্তম্ভন বলে। এমন করা যায়–
—কিন্তু বিশুয়ার সময়ের গতি ধীর করে দিল কে?
—আবার সেই একই বিপদে ফেললেন। এর সঠিক উত্তর আমি জানি না। হয়তো পাসাং মারা, হয়তো বা অন্য কোন শক্তি, যে শক্তি এখানে মানুষের অনুপ্রবেশ চায় না। এখানে যা যা ঘটেছে সবই মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করবার জন্য।
এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছু বলবার ছিল। ফাদার ও ব্রায়েন বলেছিলেন, পাখিকে ক্রিশ্চান বিশ্বাস অনুযায়ী কোথাও কোথাও ঈশ্বরের দূত বলে মনে করা হয়। পাখির মড়ক কোনো অমঙ্গলের আগাম সূচনা দেয়। কিন্তু সুদূর ইউরোপের মাটিতে জন্মানো এক লোকায়ত বিশ্বাসের সঙ্গে এই বিহার আর উড়িষ্যার প্রান্তবর্তী অরণ্যের কি যোগাযোগ আছে? কিংবা হয়তো প্রকৃতির কোনো কোনো নিয়ম পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই এক। সে জন্যই তারানাথের মুখে শোনা রাম গাঙ্গুলীর গল্পের মত এখানেও বিশাল বৃদ্ধ নারিকেল গাছ হঠাৎ হাওয়ায় উবে যায়।
মৃত্যুঞ্জয় তার হাতের ছড়িটা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে তাবুর দিকে। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে। কাঠিটা দিয়ে মাটিতে কী মেপে দেখছে। তার অপস্রিয়মাণ চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হল এই বিশাল জগতের তুচ্ছাতিতুচ্ছ তৃণখণ্ড থেকে অনাদ্যন্ত মহাকাশে জ্বলন্ত নক্ষত্রের দল পর্যন্ত একটা অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত বাস্তব আত্মীয়তার সূত্রে গ্রথিত। প্রাত্যহিকতার। মায়ায় সত্যের এই অগ্নিময় জ্বলন্ত রূপ আমাদের চোখে পড়ে না। কলকাতা শহরের উপগলির এঁদো মেসের ঘর নয়, সমস্ত বিশ্বের বিচিত্র বিস্ময়পূর্ণ পরিধিই আমারও জীবনের পরিধি, জ্বলন্ত নক্ষত্ৰবেষ্টিত সত্যের অলাতচক্র। মৃত্যুঞ্জয় অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে, এইবার সে ঝোপের ওধারে বাঁক ফিরবে। গলা একটু উঠিয়ে ডাকলাম—মৃত্যুঞ্জয়!
সে ফিরে তাকালো। বলল—কী?
বললাম—শুনে যাও! দরকার আছে।
মৃত্যুঞ্জয় এসে সামনে দাঁড়ালো। বললাম—একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তাই ডাকলাম।
—কী?
—সিমডেগা আসবার সময় রাউরকেল্লা এক্সপ্রেসে তুমি আমাদের সঙ্গে ছিলে, তাই? মাঝপথে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে? তোমার মুখ দেখতে পাইনি যদিও তবু আমি নিশ্চয় করে জানি সে অন্য কেউ নয়–
মৃত্যুঞ্জয় চুপ করে রইল।
মেঘ কেটে যাচ্ছে মাথার ওপরে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে সামান্য এক ফালি মেঘভাঙা রোদুর এসে পড়ল। এই অদ্ভুত আলোটা আমাকে ছোটবেলা থেকে ভারি। মুগ্ধ করে, যেন কোন্ রূপকথার দেশের ছবি ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। সে এমন এক জগৎ যেখানে সবই সম্ভব, যেখানে যুক্তি-তর্কের বিচারে সত্যের নির্ণয় হয় না। সেই আলোতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়ের মুখ।
আমার দিকে তাকিয়ে ছিল মৃত্যুঞ্জয়। এবার সে বলল–ঠিক ধরেছেন। জীবন আর জগৎ অনেক বড়, হিসেব কষে তার কূল খুঁজে পাবেন না। যুক্তি আর তর্ক তো সেই অনন্তকে মাপবার জন্য মানুষের একটা অসহায় প্রচেষ্টা। সত্যিকারের মাপকাঠি চাই–
—সে মাপকাঠি কী করে পাওয়া যায়?
–কারো কারো কাছে থাকে। যেমন এইটে–
মৃত্যুঞ্জয় তার হাতের লাঠিটা দেখাল। এইরকম সরু লাঠি বা কঞ্চি দিয়েই সে মাঝে মাঝে মাপ-জোক করে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে বটে। যেমন করেছিল বাহিরগাছি গ্রামে সেই কবে। বললাম—এটা কি বিশেষ কোনো গাছের ডাল?
মৃত্যুঞ্জয় হেসে বললনা না, তা কেন হবে! শাস্ত্রে ব্রহ্মস্ত্রের কথা পড়েছেন তো? ঐ নামে আসলে কোন অস্ত্র ছিল না। ব্রহ্মাস্ত্র একটা তেজ বা শক্তির নাম। উপযুক্ত লোক প্রয়োজন হলে এক টুকরো ঘাস তুলে নিয়ে মন্ত্র পড়ে তাতে ব্রহ্মাস্ত্রের অধিষ্ঠান ঘটাতেন। সেই তৃণখণ্ড শত্রুর দিকে ছুঁড়ে দিলে নিমেষে তা সবকিছু ছারখার করে দিত। এও তাই।
আবছা আবছা কিছু বুঝলাম, অনেক কিছুই পরিষ্কার হল না। বললাম—তুমি কে
মৃত্যুঞ্জয়?
সে হেসে বলল—তা কি আমি নিজেই জানি? কী যেন একটা কাজ আছে আমার, সেটাই করে বেড়াই। কাজ হয়ে গেলে ফিরে যাবো।
–কোথায় ফিরে যাবে?
—বিশ্বাস করুন, তা আমি ঠিক করে জানি না। এই যে এত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীতে, এরা কি জানে কোথা থেকে এসেছে বা কোথায় ফিরে যাবে? আমিও তাদেরই মতো। আচ্ছা, একটু ওদিকে যাই।
মুহূর্তে মুহূর্তে উন্নতি হচ্ছে আবহাওয়ার। এ যেন আরো বিস্ময়কর। মেঘ করে অন্ধকার ঘনিয়ে এসে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে দুর্যোগ শুরু হওয়াকে তবু কোনরকমে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সেই ঘনঘোর দুর্যোগ কাটবার যে স্বাভাবিক ছন্দ আছে তাকে অগ্রাহ্য করে এই অলৌকিক উন্নতি ভয় ধরিয়ে দেয়।
তাঁবুতে ফিরে এলাম। মেজকর্তা একটা টেবিল টেনে বসে কী লিখে চলেছেন। পাশেই দুটো চেয়ারে অসিতবাবু আর নির্মলবাবু বসে। আমাকে দেখে অসিতবাবু বললেনওয়েদার কী দারুণভাবে ইম্প্রুভ করে গেল, না?