মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম—বাহিরগাছিতে আর পরে জয়তলা গ্রামে তোমার নাম বলেছিলে অমরজীবন। নামটা বদলে গেল কী করে?
—দুটো নামের মানেই তো এক, তাই না? নাম একটা যা হোক হলেই হল—
তারপর চারদিকে তাকিয়ে প্রসঙ্গ বদলাবার ভঙ্গিতে বলল-ঝড়বৃষ্টি কিন্তু ধরে আসছে, দেখেছেন? আর বাড়বে না। বিকেলের দিকে সূর্যও বেরিয়ে আসবে।
বললাম তোমার বিষয়ে যে আমি আগে থেকেই জানি তা আর আমার কোম্পানির লোকেদের বললাম না, বুঝলে? এরা অবাক হয়ে যাবে, বুঝবে না। এটা গোপনই থাক।
আমরা ফিরে এলাম তাঁবুর কাছে। মেজকর্তা বললেন—আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে আসছে। কুলি পেলে একবার চেষ্টা করে দেখা যেত–
মৃত্যুঞ্জয় বলল—সেটা বোধহয় উচিত হত না। যিনি বাতাস কমিয়েছেন তার কাছে অবাধ্যতা করা ভাল নয়। তাহলে আবার দুর্যোগ ঘনিয়ে আসবে, আমিও আর একই ব্যাপার নিয়ে দুবার বলতে পারব না—
মেজকর্তা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন—আরে! তুমি কি পাগল নাকি? ঝড়বাদল তুমি কমালে?
—না, না! আমি কমাবো কেন? যে কমায় তাকে বললাম, সে যা করবার করল। নইলে আপনাদের খুব অসুবিধা হত।
মেজকর্তার মুখে ব্যঙ্গ আর অবিশ্বাস মেশানো হাসি ফুটে উঠল।
তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল—আপনার বিশ্বাস জন্মানোর দায়িত্ব আমার ওপরে নয়, আর ভেলকি দেখানো তো একেবারেই নিম্নমার্গের ব্যাপার। কিন্তু আপনি কর্তার ক্ষমতায় সংশয় প্রকাশ করছেন, আমার একটা কিছু তো করা উচিত–
মেজকর্তা বললেন–কর্তা কে?
—আমিও ঠিক জানি না। দেখিনি তো কখনও। তবে কর্তাই সব। আচ্ছা, আপনি। একটা সিগারেট ধরান না কেন—
—সিগারেট ধরাবো? কেন? হঠাৎ সিগারেট ধরাবো কেন?
মৃত্যুঞ্জয় বলল—কোন কারণ নেই। আপনি চেষ্টা করলেও পারবেন না, তাই বলছি–
—সে কী! সিগারেট ধরাতে পারবো না কেন?
—দেখুন চেষ্টা করে।
মেজকর্তা ধরেই নিয়েছেন তিনি পাগলের সঙ্গে কারবার করছেন। তার সঙ্গে কিছু কৌতূহলও এসে মিশেছে। পাগলকে খুশি রাখাই ভালো এই সাব্যস্ত করে তিনি পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বের করলেন। কিন্তু কিছুতেই ধরাতে পারলেন না।
ঠোটের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে যতবার দেশলাই জ্বাললেন ততবারই একটা দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে কাঠিটা নিভিয়ে দিল। দুবার…তিনবার..চারবার…প্রতিবারই কেবলমাত্র দেশলাই-এর কাঠি জ্বলবার মুহূর্তে বাতাসের ঝাপটা আসছে, পর মুহূর্তেই চারদিক আবার শান্ত হয়ে যাচ্ছে।
মুখে বিস্ময় নিয়ে মেজকর্তা মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখে আর অবিশ্বাসের চিহ্ন নেই।
মৃত্যুঞ্জয় বলল—চমকাবেন না, এর মধ্যে যাদুর খেলা কিছুই নেই। কর্তার কাছে ঠিকমতো প্রার্থনা করতে পারলে এসব আপনা আপনিই হয়ে যায়।
এবার আর মেজকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন না—কর্তা কে?
মৃত্যুঞ্জয় বলল—কাজে বাধা দিচ্ছি বলে আমাকে শত্রু ভাববেন না। এই যে আমার হাতের কাঠিটা দেখছেন, এটা হল ওই ওপরের বড়কর্তার সব কিছু মাপবার গজকাঠি। এ দিয়ে মাপলে যে কোন জায়গার ভালো-মন্দ দোষ-গুণ সব বলে দেওয়া যায়। তা আপনাদের কাজের জায়গা মাপতে গিয়ে দেখলাম মাপটা হারিয়ে যাচ্ছে। শুরু করছি এক। জায়গায়। কিন্তু কোথাও গিয়ে থামছে না। তাছাড়া এখানকার জমিও মানুষের কোলাহলকে বরদাস্ত করবে না।
মেজকর্তা বললেন—সেটা তুমি কী করে বুঝলে?
–বা রে, আমি মাটি শুকে দেখলাম যে! এ জায়গায় অতীতে কোন মানুষ কখনও বাস করেনি। ভবিষ্যতেও করবে না। মাটি খুঁকে ওসব বোঝা যায়–
আমাদের খুব বেশি বোঝাবার দরকার ছিল না। ব্যাখ্যার অতীত ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। আশ্চর্য স্বপ্ন দেখা, বনস্পতির অন্তর্ধান, বিশুয়ার জীবন থেকে কয়েক ঘণ্টা সময় হারিয়ে যাওয়া—এসব আমাদের মনের ওপর একটা কালো ছায়া বিস্তার করে রেখেই ছিল, তার ওপরে কুলিদের পলায়ন কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব করে তুললো। এসব আবছা কথা কোম্পানিকে যে রিপোর্ট দেওয়া হবে তাতে লেখা যায় না। কিন্তু পুরনো এবং পাকা। কর্মচারীরা রিপোর্ট লেখার নানারকম কায়দা জানেন। বাস্তব অসুবিধেগুলোকে তুলে ধরে মেজকর্তা রিপোর্ট লিখে কাজ বন্ধ করে দিতে পারবেন, কিন্তু তার মুখ দেখে বড় মায়া লাগলো। দক্ষ ও বুদ্ধিমান মানুষ দুর্বোধ্য, ব্যাখ্যাহীন প্রহেলিকার মুখোমুখি হলে তার মুখভারের কী করুণ আর বিপন্ন অবস্থা হয় তা দেখলাম। মেজকর্তা নিজের তাবুতে ঢুকে গেলেন। আমরা আবার হাঁটা শুরু করে ওপাশের জঙ্গলে গিয়ে পড়লাম।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম—মৃত্যুঞ্জয়, এত পাখি মারা পড়ছিল কেন বলতে পারো? সিমডেগাতে, আসবার পথে সাম পাহাড়টোলির কাছে–কী ব্যাপার বল তো? এর কি কোনো মানে আছে?
মৃত্যুঞ্জয় আমার দিকে তাকালো, বলল—মানে তো আছেই। ঠিক সময় থেমে না গেলে পাসাং মারার অনুচরেরা সব একসঙ্গে বেরিয়ে আসতো, কেউ তাদের সামলাতে পারতো না। খামোখা কিছু নিরীহ মানুষের প্রাণ যেত। আমি কর্তার কাছে দরবার। করেছিলাম, আপনারাও কাজ বন্ধ করা ঠিক করলেন, তাই ব্যাপারটা মিটে গেল, পাখি মরাও বন্ধ হয়ে গেল। পাসাং মারার অনুচরেরা সব আবার ফিরে গেছে মাটির তলার অন্ধকারে। এখানে ওখানে মাটিতে গর্ত দেখলেই বুঝতে পারবেন।
আমি বললাম—গর্ত? গর্ত কী রকম!
—অশুভ শক্তির সাঙ্গো-পাঙ্গরা বাধা পেলে তাড়াতাড়ি অন্ধকার পাতালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। যেখান দিয়ে তারা মাটিতে ঢোকে সেখানে একটা করে সাপের গর্তের মত ছোট গর্ত তৈরি হয়। দেখলে অবিকল ছুঁচো বা সাপের গর্ত বলে ভুল হবে—