—আজ্ঞে, সব বুঝতে পারবেন। আজকেই সব দেখিয়ে দেব। বেলা হয়েছে। একটু খাওয়াদাওয়া করে নিই, কেমন? তারপরে কাজ শুরু করা যাবে। আপনাদের আজকে মাছ-মাংস কিছু রান্না হয়নি তো? স্বপ্ন দেখতে আর মাটি শুকতে হলে সেদিন মাছ-মাংসটা
খাওয়াই ভাল। তাতে হিসেবের গোলমাল হয়ে যায়।
মৃত্যুঞ্জয়কে কেউ তখনও খাবার নিমন্ত্রণ করেনি। কিন্তু নিজে থেকেই সে এমনভাবে প্রসঙ্গটা তুললো যে, মনে হল এটা তার অত্যন্ত স্বাভাবিক অধিকার। এ মেজকর্তা বললেন—নিরামিষ খাবারই পাবে।
জলধর পণ্ডা সার্ভেয়ার সাহেব আর মেজকর্তার সঙ্গে জরুরি কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অসিতবাবু তাঁবুতে ফিরে গেলেন বোধকরি ভুলে যাওয়ার আগে সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে ঠিকঠাক লিখে রাখার জন্য। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলাম। যেখানে সেই বিরাট বৃদ্ধ নারিকেল গাছকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, সেখানে মৃত্যুঞ্জয় চিন্তিত মুখে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাটিতে বিশাল পাথরটা হড়কে যাওয়ার চওড়া গভীর দাগ। যেন একটা রাজপথ তৈরি হতে আরম্ভ করে থেমে গিয়েছিলো। আমার পায়ের আওয়াজে মুখ তুলে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল—এই যে!
আমি তার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলাম—তুমি বাহিরগাছি গ্রাম চেনো?
তার মুখে বিশেষ কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। সে বলল-ওঃ, আপনি বুঝতে পেরেছেন তাহলে!
–বাহিরগাছিতে চক্রবর্তী পরিবারের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে, তাই না? আদিনাথ চক্রবর্তীকে মনে পড়ে?
–পড়ে। কিন্তু সে তখন নিতান্তই বালক। তার পরে তাকে আর কখনও দেখিনি।
—সেই বালক আদিনাথ চক্রবর্তী বুড়ো হয়ে মারা গেছে আজ বহুদিন। শুনেছি তখন নাকি তোমার বয়স পঁয়ত্রিশ কী চল্লিশ ছিল। এখনও তোমার সেই বয়েস থাকে কী করে? হিসেবমত তোমার বয়েস তো একশ ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত–
এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় একটু হাসল।
বললাম—আদিনাথ চক্রবর্তীর ছেলের সঙ্গেও তো তোমার দেখা হয়েছিল, তাই না? দেখা হয়েছিল না বলে আলাপ হয়েছিল বলাই ভাল। অন্ধকার রাত্তিরে মন্দিরের চাতালে শুয়ে কেউ কারো মুখ যখন দেখতে পায়নি–
মৃত্যুঞ্জয় মিষ্টি করে হেসে বলল—আপনি তো সব জানেন দেখছি। অবশ্য জানবেনই তো, আদিনাথ চক্রবর্তীর ছেলে তারানাথ চক্রবর্তী আপনাকে জানিয়ে দিয়েছেন আজ আমি আসব, ঠিক তো?
এখনও ভাবলে অবাক লাগে, কী করে সেদিন মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা হওয়াটা আমি এত সহজ ভাবে নিয়েছিলাম। অলৌকিক ঘটনার কথা আমরা শুনি বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সীমানায় খুব বেশি একটা পাই না। কে জানে কী করে সেদিন মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিলাম।
হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে মৃত্যুঞ্জয় যেখানে পাথরটা সরে যাওয়ার দাগ হয়ে রয়েছে সেখান থেকে একমুঠো মাটি হাতে তুলে নিয়ে গভীরভাবে শুকতে লাগলো। তার মুখচোখ গম্ভীর, মগ্নতায় আবিষ্ট।
বললাম—ও কী হচ্ছে?
—মাটি শুঁকছি।
—সে তো দেখতেই পাচ্ছি। মাটি শুঁকে কী হবে?
আমার দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল—মাটিই তো সব। মাটিতে সৃষ্টি, এই মাটিতে প্রতিষ্ঠা, মাটিতে মৃত্যু। মাটিতে মহাকাল মিশে থাকে। বৈদ্য যেমন রোগীর নাড়ি থেকে শরীরের গতিক বুঝতে পারে, তেমনি মাটি খুঁকে সবকিছু বলে দেওয়া যায়–
—এখন কী বুঝতে পারলে?
–বুঝলাম এ জায়গা অন্যের অধিকারে।
এখানে কিছু না করাই ভাল। —অন্যের অধিকারে মানে? কার অধিকারে? মৃত্যুঞ্জয় প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল কী বলি বলুন তো, নাম তো কিছু নেই। শুধু বলতে পারি এ শক্তি জীবন আর স্থিতির বিরোধী–
–তার মানে অশুভ শক্তি?
—মোটেই নয়। আমাদের পক্ষে অসুবিধেজনক বলে অশুভ হতে যাবে কেন? যে কোনো একজন শান্ত, ভদ্র গৃহস্থ কি অশুভ শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে? কিন্তু তার বাড়ির উঠোনে নিজের প্রয়োজনে আপনি যদি গিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকেন, তাহলে সে নিশ্চয় লাঠি নিয়ে হৈ হৈ করে তেড়ে আসবে, যতরকম ভাবে বাধা দেওয়া যায় তার চেষ্টা করবে। তার জন্য তাকে কি খুব পাজি বা দুষ্টু লোক বলা উচিত হবে? নিজের স্বাভাবিক অধিকারে হাত পড়লে সবাই রেগে যায়—
বন থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটি ভারি আশ্চর্য কথা বলে। পণ্ডিতের মত কথা। বললাম—কিন্তু এ শক্তির রূপ কী? পরিচয় কী?
—কিছু না। সৃষ্টির সময় থেকেই আলো আর অন্ধকারের মত বিরোধীশক্তি আর মিত্রশক্তির উদ্ভব। জাতি, ভাষা, ধর্ম অনুযায়ী এক এক জায়গায় এক এক নামে মানুষ ডাকে। পরিচয় আর কী থাকবে?
বললাম—তুমি তাহলে এখন কী করবে? এর থেকে রক্ষা পাবার উপায় কী?
মৃত্যুঞ্জয় বলল—যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেটে যায়, কারো প্রাণহানি না হয় সেজন্য আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি, মিত্রশক্তির দেবতার আশ্রয় নিচ্ছি। কিন্তু এ জায়গা থেকে আপনাদের। চলে যেতে হবে। কিছু জায়গায় কিছু কাজ করা যায় না।
—মিত্রশক্তির দেবতা কে?
—জানি না। দেবতার আবার নাম-গোত্র কী? তবে তার আশ্রয় গ্রহণ করলে ভয় কেটে যায়। শাস্ত্রে বলেছে—
ভূতপ্রেতপিশাচশ্চ রাক্ষসা দুষ্টচেতসঃ।
সর্বেতে প্রলয়ং যান্তি বিশ্বমিত্রস্য প্রসাদতঃ ॥
২১. পাখির ডাক ভেসে এল
হঠাৎ পাশের একটা গাছ থেকে পাখির ডাক ভেসে এল। একটু আশ্চর্য হয়ে ওপরে। তাকালাম। গত কয়েকদিন বনের ভেতর পাখিদের শব্দ শুনতে পাইনি। সেই অপার্থিব স্তব্ধতা কাটিয়ে প্রথম এই ডাক পরিবেশের বিষণ্ণতা অনেকখানি দূর করে দিল। হ্যাঁ, ওই যে পাতার আড়ালে বসে রয়েছে পাখিটা, কী পাখি বুঝতে পারা যাচ্ছে না, কিন্তু পাখি বটে। যাক্, তাহলে পাখিরা ফিরে আসতে শুরু করেছে। ভাল।