মেজকর্তা বললেন—ওটা কিছু নয়। এই জঙ্গলে আর অন্য কোন গাড়ি আসবে? ও তো আমিও বলতে পারতাম–
মেজকর্তা অবশ্য কথাটা মজা করে বললেন। কিন্তু বিশুয়া আহত অভিমানের সুরে বলল—বলেন কী কর্তা! আমার চোখ বেঁধে সামনে একে একে পঞ্চাশটা গাড়ি স্টার্ট দিন, আমি বলে দেব কোন্টা কোন্ গাড়ি–
লরি এসে ব্রেক কষল সামনে। চড়াই ভেঙে ওঠার জন্য রেডিয়েটরের জল ফুটছে। জলধর পণ্ডা নেমে এসে দাঁড়াল, সে কুলি পায়নি—এ কথা তার আর মুখে বলবার দরকার হল না। বিশ্বস্ত কাজের লোক কোনো কাজে ব্যর্থ হলে তার চেহারায় একটা গ্লানির ছাপ ফুটে ওঠে, জলধরেরও তাই হয়েছে। সে বলল—কী করে এত তাড়াতাড়ি এরা খবর ছড়ায় জানি না কর্তা, নাকি এদের মাথার মধ্যে সত্যি সত্যি টনক আছে, তাই বা কে জানে! চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর সিমডেগা, কোলেবিরা, সীসা আর জঙ্গলের ভেতরকার বস্তি—সবজায়গার লোকেরা বেঁকে বসেছে। জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলে না। ডবল মজুরি অবধি কবুল করেছি কর্তা—যেমন আপনি বলে দিয়েছিলেন, তাতেও কিছু হয়নি।
এইসব কথা হচ্ছে, হঠাৎ লরীর থেকে পেছনের খোলা ডালার দিক দিয়ে একজনকে। নামতে দেখলাম। এ আবার কে? একে তো আমাদের দলে আগে দেখিনি। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে অন্যরাও তাকাল। মেজকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন—এ লোকটি কে জলধর?
জলধর একটু ইতস্তত করে বলল—আজ্ঞে, আমিও ঠিক চিনি না–
—চেন না মানে? তোমার সঙ্গে এল, আর তুমি চেন না?
—না কর্তা। মাঝপথে হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে থেকে উঠে এসে রাস্তার ওপর দাঁড়াল। সেখানে কোথায় ফেলে আসব, তাই সঙ্গে নিয়ে এলাম–
লোকটি কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বছর চল্লিশ কী বেয়াল্লিশ বয়েস হবে, বেশ ভদ্র আর সৌম্য চেহারা। জামাকাপড় অত্যন্ত সাধারণ হলেও লোকটিকে ঠিক ভবঘুরে শ্রেণীতে। ফেলা যায় না। তার হাতে একটা সরু, লম্বা গাছের ডাল। জঙ্গলের ভেতরে কোথাও থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে বোধহয়। গাছের ডালটা দেখে আমার মনের ভেতর একটা ঘণ্টা বেজে উঠল। কিছু মনে পড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস।
লোকটি সাধারণভাবে আমাদের সকলকে উদ্দেশ করে বলল-নমস্কার।
শিক্ষিত মানুষের বাচনভঙ্গি। মোটেও ভবঘুরেদের মত নয়। মজার ব্যাপার তো!
মেজকর্তা বললেন—নমস্কার। তুমি কে?
লোকটি মুচকি হেসে বলল—পথিক। আপাতত আপনাদের অতিথি।
—নাম কী তোমার? এখানে কোথা থেকে এলে?
লোকটা একটু চিন্তা করল।
—নাম? নাম ধরুন মৃত্যুঞ্জয়। আমি এমনি পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বাড়ি-টাড়ি কিছুই নেই। যেখানে থাকতে পাই থাকি, যেখানে খেতে পাই খাই। এখন বনের ভেতর দিয়ে। হাঁটছিলাম, আপনাদের গাড়ি দেখতে পেয়ে তাতে উঠে বসেছি। ব্যস, চলে এলাম।
কিন্তু ব্যাখ্যাটা অত সহজ নয়। জনমানবহীন অরণ্যে, যাকে ইংরেজিতে বলে In the middle of nowhere, সে একা কী করছিল? যেখান থেকে সে লরীতে উঠেছে সেটা সবচেয়ে কাছের লোকালয় থেকে অন্তত দেড়দিনের হাঁটাপথ। খাবার বা জল না নিয়ে। এই দেড়দিন সে কীভাবে কাটিয়েছে জঙ্গলের ভেতর? পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছে, তার। মানে সে বাঙালী। বিহার-উড়িষ্যার সীমান্তবর্তী দুর্গম অরণ্যে একজন ভবঘুরে বাঙালী কীসের আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? একে আমি চিনি এমন কথাই বা আমার মনে হচ্ছে কেন?
মৃত্যুঞ্জয় বেশ সহজ ভঙ্গিতে একবার চারদিকে তাকাল, তারপর বললবেশ জায়গা, কিন্তু এখানে তো আপনারা কারখানা বানাতে পারবেন না কর্তা–
মেজকর্তা ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বললেন—আমরা এখানে কারখানা করতে চাই একথা তোমাকে কে বলল?
–ওটার মধ্যে কোনো যাদু নেই। আসবার সময় আপনার লোকেদের কাছেই শুনেছি।
—কেন, কারখানা করতে পারব না কেন?
মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলল—কর্তা, কিছু কিছু কেন-র কোনও উত্তর হয় না। মেনে নিতে। হয়। এই তো দেখুন না, এখনও তো বর্ষা নামেনি, তবু ক’দিন তেমন আকাশ মেঘে ঢাকা আর বৃষ্টি হয়ে চলেছে। যদি প্রশ্ন করেন কেন হচ্ছে, কেউ কী তার উত্তর দিতে পারবে? কেবল দু’একজন বিশেষ মানুষ ছাড়া?
নির্মলবাবু এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার বললেন—বিশেষ মানুষ আবার কে? কী বলছ হে তুমি?
মৃত্যুঞ্জয় বলল—বিশেষ লোক বলতে যারা এসব ব্যাপার ঠিকঠাক জানে আর কী। এই যেমন আমি
নির্মলবাবু বললেন—তুমি ধাঁধায় কথা বলছ কেন? কি জান তুমি?
মৃত্যুঞ্জয় বলল—এই যেমন বলে দিলাম এখানে আপনারা কাজ করতে পারবেন না। কারণ কী জানেন? কারণ হল পৃথিবীতে কিছু কিছু জায়গা মানুষের, কিছু কিছু জায়গা। মানুষের নয়। নিজের অধিকারের গণ্ডি পার হয়ে ওদিকে পা দিলে তাতে সব গোলমাল হয়ে যায়।
মেজকর্তা বললেন—এত সব কথা তুমি শিখলে কোথায়? এ তো টোলের পণ্ডিতমশাই-এর মত কথা।
মৃত্যুঞ্জয় বলল—আজ্ঞে, আমি জানতে পারি। স্বপ্ন দেখি কী না। তার পরে ধরুন। মাপজোক আছে, মাটি শোঁকা আছে। এসব মিলিয়ে আমি টের পেয়ে যাই–
আমি চমকে তার দিকে তাকালাম। মনে হল আমি তাকে চিনতে পেরেছ। তারানাথের মুখে শোনা সেই বাহিরগাছি গ্রামের গল্প। রামজয়পুরে সরসী চাটুজ্জের বৈঠকখানা। কিন্তু যার কথা তারানাথ বলেছিল তার নাম তো মৃত্যুঞ্জয় নয়। কী যেন নামটা! আবছা আবছা মনে পড়লো। সে নামের অর্থও মৃত্যুঞ্জয় গোছের কিছু। অবশ্য মেজকর্তা বা নির্মলবাবুর সামনে এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করা সঙ্গত মনে করলাম না।
মেজকর্তা বললেন তুমি ভারি অদ্ভুত কথা বলে তো! মাপজোক কীসের? মাটি শোকাই বা কাকে বলে?