পতিরাম মজুমদার আদিনাথের কাহিনী শেষ হলে পরিত্রাণের আশা করেছিলেন, এবং সম্প্রতি বাড়ি ফেরবার উদ্যোগ হিসেবে চাদর কাঁধে ফেলে লাঠির খোঁজ করছিলেন। আর একটা অপ্রাকৃত গল্প শুরু হতে চলেছে দেখে তিনি কাতর স্বরে বললেন—আর নয়, আজ আর নয়! এবার সবাই উঠে পড়া যাক, চল। পথ তো কম নয়, আমায় যেতে হবে সেই পশ্চিমপাড়া। তাছাড়া সরসীভায়ারও তো খাওয়াদাওয়া আছে।
সরসী চাটুজ্জে হেসে বললেন—আমার খাওয়ার এখনো ঢের দেরি। শোনাই যাক না গল্পটা। বাকিদের কী মত?
সকলে বললেন-গল্প হোক! গল্প হোক!
‘ওমাঃ!’ বলে হতাশ ভঙ্গিতে পতিরাম দেয়ালে ভর দিয়ে এলিয়ে বসলেন।
রাম গাঙ্গুলি বললেন—আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা বলছি। তখন আমার বয়েস আর কত হবে, ধর কুড়ি কী বাইশ। সে বয়েসে আমি যে কী ডানপিটে ছিলাম, যারা আমাকে এখন দেখছ তারা ধারণাও করতে পারবে না। পেটের গোলমাল আর হাঁটুর বাত আমাকে অকেজো করে দিয়েছে, নইলে আট-দশ বছর আগেও আমি নিমগাছে উঠে দাঁতন পেড়েছি। যাই হোক ঘটনাটা বলি। আমার কৈশোরের বেশ কয়েকবছর আমাকে মামাবাড়িতে কাটাতে হয়েছিল। দাদামশায় ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ, পণ্ডিত মানুষ। মামারাও সবাই লেখাপড়া জানা। আমার বাবা তখন জরিপ বিভাগে কাজের সূত্রে তরাইয়ের জঙ্গলে কর্মরত। বাড়ির কাছে কোনো ভাল স্কুল নেই, বাবা বছরে দু-একবার ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেন। এমন অবস্থায় আমার পড়াশুনো হওয়া কঠিন দেখে মা আমাকে মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দাদুর কাছে আমার লেখাপড়ার শুরু। ইংরিজি জানিনে বটে, কিন্তু ব্যাকরণ আর বেদান্তে আমি অল্পবয়েসেই কিছুটা অধিকার অর্জন করেছিলাম। যে বছর পড়া সাঙ্গ করে বাড়ি ফিরে আসি, সে বছর কালীপূজোর সময় আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
মামাবাড়ির গ্রামের উত্তরে ছিল পুঁটি নদী। নদীর খাত চওড়া, কিন্তু পলি পড়ে তার স্রোত ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। দক্ষিণ আর পশ্চিমে বিশাল এক জলাভূমি গ্রামটাকে বাইরের জগৎ থেকে পৃথক করে রেখেছে। প্রায় দ্বীপের মত এই গ্রাম থেকে বাইরে যাবার একমাত্র ভাল রাস্তা পূবদিক দিয়ে। আর একটা পথ জলার ভেতর দিয়ে অনেক ঘুরেফিরে মহকুমা শহরে যাবার পাকা সড়কে পড়েছে বটে, কিন্তু সে পথ বিশেষ কেউ ব্যবহার করে না। নানান ভৌতিক কাহিনীর গুজব চালু ছিল জলাভূমিটা সম্বন্ধে। নরম কাদা, নলখাগড়ার বন, উলুঘাসের আর হোগলার জঙ্গল আর মাঝে মাঝে এক একটা জায়গায় একটু ঘাসজমি, তাতে একটা-দুটো বড় গাছ, এই নিয়ে সে জলাভূমির বিস্তার। আমি আর আমার প্রাণের বন্ধু তিনকড়ি—সেও ছিল আমারই মত ডানপিটে আর নির্ভীক—এই জলাভূমির মধ্যে বেড়িয়ে বেড়াতাম। সেসব দিনের কথা মনে এলে এখন বুকের মধ্যেটা কেমন করে ওঠে। মাথায় কোনো চিন্তার ভার নেই, কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ নেই, মনে কেবল নির্মল আনন্দ, চোখে অল্পবয়েসের স্বপ্ন। অমন সব দিন আর আসবে না।
সে বছর কালীপূজো পড়েছিল বেশ দেরি করে, কার্তিকের মাঝখান পেরিয়ে। বাতাসে হিমের ছোঁয়া লেগেছে, বিকেলের পড়ন্ত বরাদুরে সোনার রঙ। সন্ধে নামছে সূর্যাস্তের পরেই। এই পরিবেশে আমাদের দুই বন্ধুর জলাভূমির ভেতর ঘুরে বেড়াতে খুব ভাল লাগত। অনেকসময় দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বেরিয়ে পড়তাম, ফিরতাম রাতের প্রথম প্রহর পার করে। ছোট ছোট ঘাসজমিগুলোতে সরু আলের মত পথ বেয়ে গিয়ে গাছের তলায় শুয়ে বসে গল্প করতাম। সবগুলোতে যাওয়া যেত না, কোনো কোনোটায় যাবার পথ ছিল। ঠিক পথ বলা যায় না, বুড়ো আঙুলে ভর করে ডিঙি মেরে মেরে চলে যেতাম কোনোভাবে। সমস্ত জলাটা আমাদের নখদর্পণে ছিল। বিশেষ মজা হত চাদনি রাত্তিরে। ওই জলাজমি, নলখাগড়া আর উলুঘাসের বন, হালকা জ্যোৎস্নায় বড় বড় গাছের ছায়া—সব মিলিয়ে রূপকথার রাজ্য তৈরি করত। আর ওই বয়েস—বুঝতেই পারছ, জীবনে তা একবারই আসে। যেন মেঘের ওপর ভেসে বেড়াতাম তখন।
কালীপূজোর ঠিক আগের দিন, সেদিন ভূতচতুর্দশী, তিনকড়ি সকালের দিকে আমাকে এসে বলল—রাম, চল আজ বিকেলে জলার ভেতর বেড়াতে যাই। একেবারে সন্ধের পর একটু রাত্তির করে ফিরব। আজই রাত্তিরে অমাবস্যা লাগবে, এত অন্ধকারে কখনো ওখানে বেড়াই নি। পথঘাট তো সবই আমাদের চেনা। যাবি?
সত্যিই, পুরো জলাভূমিটা আমরা নিজেদের হাতের তালুর মত চিনতাম। সন্ধে হয়ে গেলেও অসুবিধের কোনো কারণ নেই। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
একটু পড়ন্ত বেলায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গ্রাম ছাড়িয়ে আরো মাইলখানেক হেঁটে এসে পড়লাম জলাভূমির প্রান্তে। তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে, দিনের আলো মিলিয়ে গিয়ে নামছে আবছায়া অন্ধকার। তিনকড়িকে বললাম—হারে ভেতরে ঢুকবি? নাকি এইখানে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে ফিরে যাই চল–
তিনকড়ি হেসে বলল-কেন, ভয় করছে বুঝি?
—যাঃ, ভয় কীসের? আজ অমাবস্যা পড়ছে, একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে কিন্তু–
—তার মানেই তো ভয় পাচ্ছিস। দূর, চল দেখি। অন্ধকারেই তো মজা। আয়—
এরপর না গিয়ে উপায় থাকে না। ঢুকলাম জলার ভেতরে। চারদিকে প্রায় মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে হোগলার ঝোপ। বোধহয় সেইজন্যই সেখানে অন্ধকার নামছে একটু : তাড়াতাড়ি। হালকা ধোঁয়ার মত একটা অস্পষ্ট কুয়াশা ঘনাচ্ছে। হেমন্তকালের শুরু, এই সময়ে সন্ধেবেলা বাতাস বয় না, কিন্তু লম্বা ঝোপগুলোর মধ্যে বাতাস বয়ে যাওয়ার মত একটা শী শী আওয়াজ হচ্ছে। সেটা অবশ্য আমার মনের ভুলও হতে পারে। খুব নির্জন জায়গায় কানের ভেতর রক্ত চলাচলের শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায়, মনে হয় শব্দটা যেন বাইরে থেকে আসছে।