বলে কী তারানাথ! আমি পাগল হয়ে গিয়েছি, না সে? স্পষ্ট দেখছি জলজ্যান্ত মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাহলে আসেনি মানে?
তারানাথ একটু হেসে বলল—আমি আসলে রয়েছি কলকাতায়, মটু লেনের বাড়িতে। রাত্তিরে ঘুম ভেঙে অভ্যেসমত একটু তামাক ধরিয়ে খাচ্ছিলাম, এমন সময় তোমার ডাক এসে পৌঁছল। আসবার সময় হুঁকোটা নামিয়ে রাখতে ভুলে গিয়েছি। এটা যে তোমার চোখে পড়বেই সেটা আর খেয়াল হয়নি। হাঃ হাঃ হাঃ!
একটা লোক এসেছে অথচ আসেনি—এ কেমন রহস্য! আমি এক পা এগিয়ে হাত বাড়িয়ে তারানাথকে ছুঁতে গেলাম। তারানাথ বাধা দিয়ে বলল—ওটি কোরো না, আমাকে
স্পর্শ কোরো না। আমারও ক্ষতি হবে, তোমারও।
-কেন? কী হবে ছুঁলে?
—তাহলে আমি আর থাকতে পারব না। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ছবি পুকুরের জলে পড়ে, কিন্তু জলে ঢিল ফেললে আর সে ছবি দেখা যায় কি? যাক ওসব। কথা। একটা কথা বলে যাই, এখানে তোমরা কাজ করতে পারবে না। কোনো না কোনো বাধা এসে উপস্থিত হবে। জোর করে কাজ চালাতে গেলে তার ফল খুব খারাপ হতে পারে।
—তাহলে? আমি কাজ বন্ধ করতে বললে কী কোম্পানী শুনবে?
–না। তোমার কর্তারাই বলবে। সেভাবেই রিপোর্ট লেখা হবে। তোমার পেছনে ও কী?
তারানাথ আমার পেছনে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। আমি পেছনদিকে তাকালাম। কই, কিছু নেই তো! কীসের কথা বলছে তারানাথ?
এদিকে ফিরে দেখি ঝোপের পাশ থেকে তারানাথও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারলাম তার অন্তর্ধানের দৃশ্য দেখলে আমার মনে ধাক্কা লাগতে পারে, তাই সে এই সহজ কায়দাটা করেছিল। সে এখন মটু লেনে বসে বাকি তামাকটুকু খাচ্ছে।
তাঁবুতে ফিরে এলাম। অসিতবাবু এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমিও টর্চ বালিশের নিচে রেখে আবার শুয়ে পড়লাম।
তারানাথ বলেছে কাল সমাধান আসবে। কী সে সমাধান? কোন্ রূপে আসবে?
গাছের পাতায় টিপটিপ বৃষ্টির শব্দে ঘুম এসে গেল।
২০. সকাল হল বটে
সকাল হল বটে, কিন্তু আলো তেমন করে ফুটল না। সমস্ত অরণ্যে একটা ভিজে অন্ধকার ব্যাপ্ত হয়ে রইল। ওয়ার্কিং টেন্টে বসে বাসিমুখে চা খাচ্ছি, এমন সময় বিশুয়া গম্ভীর মুখে সামনে এসে দাঁড়াল।
মেজকর্তা বললেন কী ব্যাপার বিশুয়া? মুখ অমন শুকনো কেন?
বিশুয়া বলল—বাবু, জিপ স্টার্ট নিচ্ছে না–
—তাতে মুখ শুকনো করার কী আছে? দেখ গিয়ে ভাল করে, কোনো তার-টার খুলে গিয়েছে হয়ত। ব্যাটারির টার্মিনাল আলগা হয়ে যায়নি তো?
—না বাবু। ওসব আমি দেখে নিয়েছি। একবার ভাবলাম বুঝি কোনোভাবে ডিস্ট্রিবিউটারে বৃষ্টির জল ঢুকেছে। ডিস্ট্রিবিউটার ক্যাপ খুলে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে কাগজের নুড়ো জ্বেলে গরম করে ফের লাগিয়েছি
—তাতে হল না?
—না বাবু। অথচ ট্যাঙ্কে তেল ভর্তি, তাজা ব্যাটারি—
মেজকর্তা একটু ভেবে বললেন—বিশুয়া, এ বিষয়ে আর আমি কী বলব? আমি তো আর যন্ত্রপাতির ব্যাপার কিছু বুঝি না। দেখ আর একটু চেষ্টা করে, স্টার্ট নেবে এখন—
অপ্রসন্নমুখে বিশুয়া আবার গাড়ির দিকে গেল।
নির্মল কাঞ্জিলাল বললেন—আকাশের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে আবার বৃষ্টি নামবে।
অসিতবাবু বললেন—আমার ভাল লাগছে না।
সবাই তার দিকে তাকাল। মেজকর্তা বললেন—কী ভাল লাগছে না?
—কিছুই না। দেখুন, নিজেদের মধ্যে আর লুকোচুরি না করে সত্যি কথা স্বীকার করবার সময় এসেছে। কী হচ্ছে এসব? একশো মণ ওজনের পাথর সরে গেল আপনা আপনি, হাওয়ায় উবে গেল একটা বিশাল গাছ, পাসাং মারার গান শুনে কুলিরা ফিরে গেল, সবাই মিলে রাত্তিরে একই স্বপ্ন দেখছি—এখন আবার শুনছি গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। আমি খারাপ কিছু ঘনিয়ে এলে আগে থেকে মনের ভেতরে তার আগাম ঘণ্টা শুনতে পাই। জলধরকে আমাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি, গাড়ি খারাপ হলে আমরা তো এই দুর্যোগে অসহায়ের মত আটকে পড়ব। অবশ্য আমার এ নিয়ে কথা বলা উচিত নয়, এটা আপনাদের ব্যাপার। আমি সবার নিরাপত্তার কথাই বলছি–
মেজকর্তা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন—যেখানে সকলের ভালমন্দ একসূত্রে জড়িত, সেখানে কারো কথা বলা অন্যায় নয়। তাছাড়া আমিও বুঝতে পেরেছি এখানে আমরা কাজ করতে পারব না। জলধর কুলি নিয়ে ফিরতে পারবে বলে আমি মনে করি না। সে ফেরা পর্যন্ত অন্তত অপেক্ষা করা যাক—
মাথার ওপরে গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে জল ঝরে পড়ছে। চেয়ার একটু টেনে সরিয়ে বসলাম। জলধর যদি খুব তাড়াতাড়িও ফেরে, তাহলেও কাল বিকেলের আগে নয়। আর একটা রাত্তির এই নির্জনতার মধ্যে আমরা কয়েকটি প্রাণী কাটাব। অন্য সময় হলে ভাল লাগত, কিন্তু মনে আশঙ্কা নিয়ে কোনও উপভোগই সুখের নয়।
কিন্তু পরের দিন অবধি আমাদের অপেক্ষা করতে হল না। বেলা বারোটা নাগাদ সাম পাহাড়টোলির দিকের রাস্তায় গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ পাওয়া গেল। বড়, ভারী গাড়ির। ইঞ্জিন, চড়াই দিয়ে ওঠার পথে গোঁ গোঁ শব্দ করছে। এ শব্দ আমাদের পরিচিত, তবু থেকে আমরা বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম। রান্নার তাবু থেকে বিশুয়াও বেরিয়ে এল। সে বলল—আমাদের লরি আসছে।
মেজকর্তা বললেন–কী করে বুঝলে?
–আমি আওয়াজ চিনি কর্তা। এক এক গাড়ির এক এক রকম আওয়াজ–
একমিনিটের মধ্যেই বিশুয়ার কথা সত্য প্রমাণিত করে আমাদের চেনা ট্রাক উঠে এল চড়াই বেয়ে। বিশুয়া একগাল হেসে বলল—বলেছিলাম না আমাদের গাড়ি!