টর্চ নিভিয়ে দিলাম। ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দিলাম তেলের বাতি। মুক্ত বাতাসে একটু নিঃশ্বাস না নিতে পারলে কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। পরপর অস্বাভাবিক ঘটনা আর অপার্থিব দৃশ্য আমার মনকে বিকল করে তুলেছে। টর্চ হাতে। করেই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এখানেও অন্ধকার, কিন্তু সে অন্ধকার সহজ প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক। বুঝলাম এমন কী কালোও স্বস্তিদায়ক হতে পারে বিশেষ পরিস্থিতিতে। মনের ভার একটু হালকা হলে বোতাম টিপে টর্চ জ্বাললাম।
স্বচ্ছ, সুন্দর, পবিত্র আলো। দুঃস্বপ্ন কেটে গিয়েছে।
কিন্তু না, তা বোধহয় নয়। পাহাড়েরা আজ আরো অনেক কাছে এগিয়ে এসেছে। একি শুধুই আলো-আঁধারির জন্য দৃষ্টিবিভ্রম? সচেতনভাবে এতটা ভুল দেখা কি সম্ভব? এভাবে চললে তো আর দুদিনের মধ্যে তাঁবুকে ছুঁয়ে ফেলবে পাহাড়ের সারি।
এতদিন মনে ঠিক ভয় জাগেনি। বরং বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি শীতের দিনে। আরামদায়ক চাদরের মত চেতনাকে জড়িয়ে ছিল। সেই বিশাল বনস্পতির অন্তর্ধান, ক্রমাগ্রসরমান পাহাড়, পাসাংমারার গান, এই বনভূমির নির্জনতা সমস্ত কিছুতেই মন নিজের মত একটা ব্যাখ্যা খাড়া করে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল। স্পষ্ট চোখে দেখা গেলেও প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ যুক্তিহীন কিছুকে মন মেনে নিতে অস্বীকার করে। সুস্থ থাকবার জন্য মনের এটা একটা কায়দা।
এবার জেগে উঠল ভয়। কুলিরা চলে গিয়েছে, জলধর পণ্ডাও নেই, নতুন লোকজন নিয়ে ফিরতে তার আরো অন্ততঃ দু-তিন দিন লাগবে। তেমন প্রয়োজন হলে অবশ্য জিপ নিয়ে শহরে চলে যাওয়া যায়, কিন্তু তবু রসদ কাজের যন্ত্রপাতি ফেলে যাওয়া হবেই বা কী করে? মেজকর্তা বা সার্ভেয়ার সাহেব হয়ত যেতে চাইবেন না। ওঁরা কি ঘটনাটার রহস্যময় অলৌকিক দিকটা ঠিকঠাক ধরতে পেরেছেন? শুনতে পেয়েছেন বাতাসের ফিসফাস? পেয়েছেন হয়ত, কিন্তু বলছেন না।
হঠাৎ একটা কথা মনে হল। দেবদর্শনবাবুর গ্রাম ছেড়ে বিদায় নিয়ে আসবার সময় তারানাথ তাকে বলেছিল—যদি কখনো আমাকে প্রয়োজন হয়, নির্জনে কোথাও দাঁড়িয়ে। মধুসুন্দরী দেবীর নাম উচ্চারণ করে মনে মনে আমাকে ডাকবেন। আমি ঠিক জানতে পারব।
দেবদর্শন বলেছিলেন—আপনি কীভাবে জানবেন?
তারানাথ উত্তর দিয়েছিল—ও বুঝিয়ে বলা যাবে না। তবে খবর পৌঁছবে। এখন এই মধ্যরাত্রির বৃষ্টিসিক্ত অরণ্যে দাঁড়িয়ে ভাবলাম—তারানাথকে একবার ডাকলে হয় না? যদি সে শুনতে পায় তাহলে জিনিসটার সত্যি-মিথ্যে পরীক্ষা হয়ে যাবে, আর এই পরিস্থিতিতে তার পরামর্শও আমাদের কাজে লাগবে।
এখনই ডাকব? এই এখানে দাঁড়িয়ে ডাকা যাক, দেখা যাক কী হয়।
চোখ বুজে মনে মনে তিনবার মধুসুন্দরী দেবীর নাম উচ্চারণ করে তারানাথকে স্মরণ করলাম। তাকে আমাদের খুব প্রয়োজন। আমার এই ডাক সে কি শুনতে পাচ্ছে? পেলে কি সাড়া দিতে পারবে?
আমার ঠিক পেছনে মৃদু কাশির শব্দ হল। তারপরেই খুব পরিচিত একটা গলার আওয়াজ—কী হে, ব্যাপার কী?
জীবনে কখনো এমন চমকাই নি!
আমার পেছনে ঝোপজঙ্গল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারানাথ জ্যোতিষার্ণব।
বিংশ শতকের আধুনিক মানুষ আমি, কথায় কথায় বিজ্ঞান আর সভ্যতার বড়াই করে থাকি, স্মরণ করামাত্র চারশো মাইল দূর থেকে তারানাথ আবির্ভূত হয়ে আমার যুক্তি আর বিজ্ঞানের অহঙ্কারকে মুহূর্তে বিরাট আঘাত করল।
তারানাথের পরণে ধুতি। আর গায়ে ধুতিরই খুঁট চাদরের মত করে জড়ানো। তাকে এই অন্ধকারে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু তার পরিচিত অবয়ব চিনতে একটুও অসুবিধে হল না।
তারানাথ আবার বলল—ব্যাপার কী? ডেকে এনে চুপ করে রইলে কেন?
বিস্মিত গলায় বললাম—কিন্তু আপনি—আপনি এখানে এলেন কী করে?
সে কথার উত্তর না দিয়ে তারানাথ বলল কাজের কথা বল। তুমি কলকাতায় ফিরে গেলে বাকি সব আলোচনা হবে। এখন আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।
সংক্ষেপে তারানাথকে আমাদের সিমডেগা আসা, পাখির মড়ক, বড় গাছটার উধাও। হয়ে যাওয়া, পাসাংমারার গান, কালোরঙের আলো, পাহাড়শ্রেণীর কাছে এগিয়ে আসা—সব বললাম। শুনতে শুনতে তারানাথ চারদিকে তাকাচ্ছিল, আমার কথা শেষ হলে সে বলল—একটা সমস্যা আমি এখনই মিটিয়ে দিচ্ছি। পাহাড়েরা কাছে এগিয়ে আসছে বলেছিলে না?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—চারদিকে তাকাও তো। কী দেখছ?
তাকালাম। পাহাড়েরা আবার দূরে দূরে স্বস্থানে ফিরে গিয়েছে।
বললাম—এ রকম তো আগেও হয়েছে। মাঝরাত্তিরে এগিয়ে এসে ভোরবেলা পিছিয়ে গিয়েছে। এতে কী হল?
—আর এগিয়ে আসবে না, ব্যবস্থা করে দিলাম—
—অন্য সমস্যাগুলো?
—তার জন্যও ব্যবস্থা হবে। কাল সকাল হোক, সমাধান এসে পৌঁছবে।
বুঝলাম না সকালে কী সমাধান পৌঁছবে। কিন্তু হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল করে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। খুব ঘরোয়া পোশাকে তারানাথ সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেটা না হয় মানলাম। কিন্তু তার হাতে একটা হুঁকো! এই জঙ্গলে সে হুঁকো পেল কী করে?
প্রায় চিৎকার করে উঠলাম—এ কী! আপনার হাতে হুঁকো কী করে এল?
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে তারানাথ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল—এহে, এটা তো একেবারে খেয়াল করিনি। তুমি দেখতে পাবার আগে নামিয়ে রাখা উচিত ছিল—
—কিন্তু এভাবে আপনি এলেন কী করে?
গোপন কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে লোকের যেমন মুখভাব হয় তেমনি মুখ করে তারানাথ বলল—আমি তো এখানে আসিনি।