আমি তখন ছোট, কী প্রশ্ন করা উচিত বা উচিত নয় সে বিষয়ে জ্ঞান ছিল না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু পিসিমা, আপনি যে পোড়া দেখানোর সময় কীসব বলছিলেন, তা কি কোনো মন্ত্র?
কুঞ্জপিসিমা ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন তোমার সব অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন! বৃষ্টি থেমে গিয়েছে তো? ব্যস্, আর কী চাই?
একটু পরেই রোদ্র উঠল। প্রথমে স্নান, তারপর কড়া রোদুর। কালকের ওই প্রলয়ের বর্ষণের পর আজকেই এমন রোদুর উঠবে কেউ কল্পনা করতে পারে নি। কুঞ্জপিসিমা সম্বন্ধে গল্পের ঝুলিতে আর একটা ঘটনা যোগ হল। কাদা শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেল দুদিনের মধ্যে। নির্বিঘ্নে মিটে গেল সিন্ধুদিদির বিয়ে।
গল্প শেষ করে অসিত বিশ্বাস একটু থামলেন। তাঁবুর পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলেন বাইরে, যেখানে ভেজা ঝোপঝাড় আর গাছের গুঁড়ি মায়াময় দেখাচ্ছে বিষম আলোয়। তার চোখে স্মৃতিমেদুরতার নরম চাউনি।
মেজকর্তা বললেন—আপনি খামোকই ভয় পাচ্ছিলেন বিশ্বাসবাবু, আমরা যতই সভ্য আর আধুনিক হই না কেন, এসব গল্পের মার নেই
অসিতবাবু বললেন–কী জানি, তাই হবে হয়ত। আমার ছোটবেলার গল্প বলে আমার ভাল লাগে। কিন্তু অন্যদের—যা গে, ভাল লাগলেই ভাল।
একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন—এ গল্পের একটা ছোট্ট উপসংহার আছে। সেটা বলি। আমার সেই জ্যাঠতুত দিদি সিন্ধুলতা বিবাহিতজীবনে খুব সুখী হয়েছিলেন। শিবের মত স্বামী, সুন্দর আর বাধ্য ছেলেমেয়ে। ভরভরন্ত সংসার রেখে সিন্ধুদিদি মাত্র চল্লিশ বছর বয়েসে সবাইকে কাঁদিয়ে মারা যান। এবারও তার সম্বন্ধে কুঞ্জপিসিমার ভবিষ্যৎবাণী ফলে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন সিন্ধুদিদি বাদুলে মেয়ে, দিদির জীবনের সব প্রধান দিনগুলোতে বর্ষণযোগ আছে। দিদি যেদিন মারা যান সেদিনও আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। জীবনের শেষ প্রধান দিনে। তখন আর কুঞ্জপিসিমা বেঁচে নেই, থাকার কথাও নয়। আমি তখন জীবিকার সন্ধানে বাইরে বেরিয়ে এসেছি, পরে একবার গ্রামে গিয়ে খবরটা পাই। শুনে কুঞ্জপিসির কথা মনে পড়েছিল। এর পরে আর কখনো দেশে যাইনি। যোগসূত্র একেবারেই ছিঁড়ে গিয়েছে।
সেদিন অন্ধকার নেমে এল ঝপ করে। সাধারণত দিন আর রাত্রির মাঝখানে যে সন্ধিপ্রহর থাকে, যা দিনকে সযত্ন ভালবাসায় শুইয়ে দেয় রাত্রির শয্যায়, আজ তার দেখা পাওয়া গেল না। ভেজা অন্ধকার একরাশ বিমর্ষতা নিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাদের তাঁবুগুলো আর জানি না আমার সন্ত্রস্ত মনের নিজেরই তৈরি ভুল কিনা—আবছা অন্ধকার ক্রমে গাঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে জেগে উঠল অপার্থিব এক ফিসফিসানি। খুব মৃদু, কী ভাষায় তাও বোঝা যায় না, কিন্তু অজানা আশঙ্কায় পরিবেশকে ভারি করে তোলে। বাকিরা কি শুনতে পাচ্ছে? পেলেও ভয়টা নিজেদের ভেতরেই লুকিয়ে রেখেছে, আবরণ খুলে গেলেই বিপদ।
ওয়ার্কিং টেন্টে বসে কাজের আলোচনা করতে করতে খেয়ে নিলাম। ঘি-মাখানো চাপাটি, চিনেবাদাম দিয়ে কুমড়ো-আলুর তরকারি, আর হালুয়া। বিশুয়া আমাদের সঙ্গেই তাঁবুর একপ্রান্তে মাটিতে বসে খেল। তার বিহুলভাব এখন একটু কেটেছে।
খাওয়ার পরে তাঁবুতে ফেরার জন্য বেরিয়ে দেখি বাতাসের বেগ বেশ বেড়েছে, বৃষ্টি এইমুহূর্তে ঝমঝম করে না হলেও হাল্কা মেঘের মত গা ভিজিয়ে দিচ্ছে। তাবুর। পেট্রোম্যাক্স আলোয় এতক্ষণ থাকার পর বাইরের অন্ধকারে জঙ্গলকে আরো নিবিড় কালো দেখাচ্ছে।
তাঁবুতে এসে অসিতবাবু একটা ছোট তেলের ল্যাম্প জ্বেলে লিখতে বসলেন। কীসের প্রেরণায় যে ভদ্রলোক নিয়মিত ডায়েরি লিখে চলেছেন কে জানে! এই ডায়েরি হয়ত কোনোদিনই বিখ্যাত মানুষের দিনলিপির মত ছেপে বার হবে না, হয়ত উপেক্ষার আড়ালেই থেকে যাবে চিরদিন। তবু মনে মনে অসিতবাবুর অবিচলিত নিষ্ঠার প্রশংসা না করে পারলাম না।
লেখনী চালনারত অসিতবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে। যখন ঘুম ভাঙল তখন সম্ভবত অনেক রাত। অসিতবাবু লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছেন—কিন্তু আলো নিভিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছেন। আমার বিছানার পাশে মোমবাতি আর দেশলাই আছে, বালিশের তলাতেও দু-ব্যাটারির টর্চ নিয়ে শুয়েছি। কাজেই খামোকা তেল না পুড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দেওয়াই ভাল। সেই উদ্দেশ্যে উঠে বসলাম।
একি! তাঁবুর মধ্যে এরকম আলো কেন! তেলের বাতি জ্বললে তো মৃদু হলেও সবকিছু আলোয় দেখতে পাবার কথা। এখন আমি দেখতে পাচ্ছি বটে, কিন্তু এ কেমন দেখতে পাওয়া! ডাক্তারের দোকানে একরকম ঘোলাটে খয়েরি মোটা কাচের বোতলে মি অফ ম্যাগনেশিয়া বিক্রি করে, আমি যেন ঠিক তেমনি কাচের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি। চাপা, লালচে-খয়েরি আলো চারদিকে। অনেকদিন আগে, তখন ইস্কুলে পড়ি, একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মধ্যে এইরকম আলো দেখেছিলাম। এতদিন পরে সেকথা মনে পড়ে গেল। তারপরেই চোখ পড়ল বাতিটার দিকে।
সেটা থেকে কালো রঙের আলো বেরুচ্ছে!
খুব অবিশ্বাস্য আর অপ্রাকৃত ঘটনার সরল বিবরণ দেওয়াই ভাল, সেজন্য কোনো অতিরিক্ত অলঙ্কার ব্যবহার না করে সোজাসুজি বললাম। আলো আর রঙের অভাবকে কালো বলে, তাহলে কালোরঙের আলো বলে কিছু কল্পনা করা সম্ভব কি? কিন্তু তাই দেখতে পেলাম চোখের সামনে। দেখলাম গুঁড়ো গুঁড়ো অন্ধকার লণ্ঠন থেকে বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে পরিবেশে। তাঁবুর মধ্যেকার যেটুকু অবকাশ, তা ভারি আর ঘন হয়ে উঠেছে কালোরঙের আলোর গুড়োতে। জগৎ সংসার প্রায়ান্ধকার ধূসরতায় মূৰ্ছিত। বালিশের তলা থেকে টর্চ বের করে জ্বাললাম। একই ব্যাপার। টর্চের বাল্ব জ্বলছে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে উপেক্ষা করে সেই উৎস থেকে বেরিয়ে আসছে অন্ধকারের গুঁড়ো!