এ হুকুম পালন করতে সামান্য সময় লাগল। রূদ্ধশ্বাসে ভিড়টা অপেক্ষা করছে। চরণ একটু বাদে একখানা মোটাসোটা কোলাব্যাঙ ঠ্যাঙ ধরে ঝুলিয়ে আনল। জ্যাঠামশাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কুঞ্জপিসির দিকে তাকালেন, বললেন—এবার দিদি?
—তোমাদের বাড়ির পেছনে কচুগাছের ঝোপ আছে না?
—হ্যাঁ দিদি।
–সেখানে এটাকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে আবার চারটে কঞ্চি পুঁতে এটার চারপায়ে সুতুলি দিয়ে বেঁধে চিৎ করে শুইয়ে রাখ। সাবধান! যেন ব্যথা না পায় বা মরে না যায়। গায়ে বৃষ্টির জল পড়লে ভালই থাকবে।
কৃষাণ দুজন লাফিয়ে পড়ল উঠোনে। গোলার পিঁড়ির গায়ে কঞ্চির গোছ বেঁধে রাখা ছিল, সেখান থেকে সাইজমাফিক চারটে খুলে নিয়ে তারা ব্যাঙ হাতে কচুবনের দিকে চলে গেল। কুঞ্জপিসি পেছন থেকে হেঁকে বললেন–খুব শক্ত করে বেঁধো না কিন্তু, তাহলে ওর পা ভেঙে যাবে। কোন প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। নিজের প্রয়োজনে তো নয়ই। আবার আলগা রাখলে খুলে পালিয়ে যাবে। বুঝে করো–
সারা দিনরাত পালা করে দুজন বসে নীল সামিয়ানায় হাওয়া করতে লাগল। কিন্তু। বর্ষণমুখর দিনে ওই ভারি কাপড় কি অত সহজে শুকোয়? টপটপ করে জল পড়া বন্ধ হয়ে গেল বটে, কিন্তু পুরো জিনিসটা’ ঝুপসি হয়ে ঝুলে রইল। আর সে ব্যাঙু তো চার পা বাঁধা হয়ে পড়ে রইল কচুতলায়। খুব একটা খারাপ আছে বলে মনে হল না। মাঝে মাঝে আমরা ছেলেপুলেরা তাকে দেখতে যাচ্ছিলাম, দেখছিলাম তার ফ্যাকাসে সাদা পেটের ওপর বৃষ্টির ফোটা ঝরে পড়ছে। আমাদের দেখলেই সে গলা ফুলিয়ে জাওকো, জাওকো’ করে ডাকছিল। সমস্ত বাড়িতে বেশ একটা উৎসব-উৎসব পরিবেশ। বড়রা নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন। ছোটরা অত বোঝে না, তারা মজা পেয়ে ছটফট করে বেড়াচ্ছিল।
রাত আটটার মধ্যে বাড়ির সকলের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল। আটটা মানে পাড়াগাঁয়ের অনেক রাত, বিশেষ করে বর্ষাভেজা দিনে। কুঞ্জপিসিমা শুধু একটু দুধ খেলেন—আর ঘরে তৈরি সন্দেশ। বাড়ির গরুর দুধের ছানা থেকে মেজকাকিমা বানিয়ে দিলেন। পাথরের বাটিতে সন্দেশ আর পাথরের গেলাসে দুধ। খাওয়া হলে কুঞ্জপিসি বললেন–এবার শোয়ার আগে একটা ছোট্ট কাজ বাকি। একটা কাঠির আগায় কিছুটা ন্যাকড়া জড়িয়ে তাতে তেল ঢেলে আনো তো–
কাকিমা জিজ্ঞাসা করলেন-তেল? কী তেল দিদি?
–যা তোক আনো না। রেড়ির তেল হলে ভাল হয়—
সারাদিন নতুন কাণ্ড দেখার পর বাড়ির লোকজন কোনো কিছুতেই আর তেমন করে উত্তেজিত হচ্ছিল না। কে একজন একটা ন্যাকড়ার মশাল করে আনল। কুঞ্জপিসি সেটাকে হাতে নিয়ে বললেন-এটাতে আগুন ধরিয়ে দাও
ন্যাকড়াটা ভাল করে জ্বলে উঠলে বারান্দায় পুবমুখখা হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি জ্বলন্ত আগুনের গোলাটা কাঠিসুদ্ধ তুলে ধরে ঘোরাতে লাগলেন, যেন অদৃশ্য কাকে কী ইঙ্গিত করছেন। বিড়বিড় করে কী বলতে লাগলেন। কী বলছেন ভালো বোঝা গেল না, কিন্তু মনে হল যেন কাউকে বকাবকি করছেন।
ঘোরানো শেষ হলে মশালটা বারান্দার নিচে জমা জলে ফেলে দিলেন কুঞ্জপিসি, তারপর সবার দিকে ফিরে বললেন–সূর্যকে ওঠার কথা মনে করিয়ে দিলাম। আগুন দেখে তার যদি জ্বলে ওঠবার কথা মনে পড়ে–
নীল সামিয়ানার দু’ধারে দুজন বসে সমানে পাখা দিয়ে বাতাস করে চলেছে। জ্যাঠামশাই নির্দেশ দিয়েছেন–রাত্তিরে ডিউটি বদল করে কাজ চলবে।
রাতভোর ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজ শুনলাম ঘুমের মধ্যে।
পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে প্রথমেই যা মনে হল, তা হল এই যে, পরিবেশটা কেমন যেন একটু অন্যরকম। গতকালকের চেয়ে আজ যেন কী একটা অদলবদল ঘটে গিয়েছে। ঘুমচোখে প্রথমটা ঠিক ধরতে পারছিলাম না। ঘুমের আবেশ কাটতেই বুঝতে পারলাম।
বৃষ্টির শব্দ থেমে গিয়েছে বাইরে।
বিছানা থেকে একলাফে নেমে বাইরে এসে দেখি বৃষ্টি একেবারে থেমে গিয়েছে। আকাশ থেকে মেঘ সম্পূর্ণ সরে যায়নি বটে, কিন্তু এই পাতলা ঘোলাটে আবরণ কেটে গেলেই নীল আকাশ বেরিয়ে পড়বে তা বোঝা গেল। কুঞ্জপিসিমা কম্বলের আসনের ওপর বসে আছেন, তার মুখে একগাল হাসি। তাকে ঘিরে বাড়ির কর্তারা আর মেয়েরা সবিস্ময় জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কুঞ্জপিসিমা বললেন—আমি কিছু জানি না বাবা। ভগবানকে ডেকে বলেছিলাম বৃষ্টিটা থামিয়ে দাও, নইলে সিন্ধুলতার বিয়ের কাজে অসুবিধা হবে। সিন্ধু তো আমারই মেয়ের মত। তার জীবনের একটা আনন্দের দিনে কারো যেন কোন কষ্ট না হয় তার জন্য ভগবানকে ডেকেছিলাম। ভগবান শুনলেন, এইটুকুই বলতে পারি–
মেজোকাকা বললেন—কিন্তু দিদি, এইসব যা যা করলেন—
কুঞ্জপিসি হেসে বললেন—ওসব কিছু নয়। ওসব হল কিছুটা ভড়ং আর কিছুটা আমাদের দেশী তুক। বুড়োবুড়িরা অনেকেই জানে। কাজ হয়েছে প্রার্থনায়, তুকে নয়।
বলাবাহুল্য তার কথা কেউই বিশ্বাস করল না। কুঞ্জপিসিমা বললেন–কাপড়ের টুকরোটা নিয়ে এসে তো, দেখি কতদূর শুকোলো–
সারারাত পালা করে জেগে বাতাস করার জন্যই হোক, বা সত্যিসত্যিই কুঞ্জপিসিমার তুকের গুণে হোক, ঐ মোটা কাপড়ের টুকরো কিন্তু সত্যিই খটখটে শুকনো হয়ে গিয়েছে। কুঞ্জপিসিমার নির্দেশে চরণ গিয়ে কচুতলায় শুয়ে থাকা ব্যাঙের বাঁধন খুলে দিল। সেটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। একদিন একরাত আটকা থেকে ব্যাঙটা বিশেষ নির্জীব হয়ে পড়েনি।
কুঞ্জপিসিমা বললেন—সূর্যকে কেমন আলো দেখিয়েছিলাম বল তো? আসলে মেঘবৃষ্টির দিনে সূর্য মাঝে মাঝে উঠতে ভুলে যায়, ঘুমিয়েই থাকে। ন্যাকড়ার আগুন দিয়ে আমি যা করলাম তাকে বলে পোড়া দেখানো। পোড়া দেখলে সূর্যের ওঠবার কথা মনে পড়ে যায়—