জ্যাঠামশাই একটুও দেরি না করে কৃষাণ দুজনকে বললেন-রামু, চরণ, তোমরা এক্ষুণি কুঞ্জদিদির বাড়ি চলে যাও। দিদিকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে এস এখানে। লাঠি নিয়ে যাবে। দুজনে শক্ত করে লাঠির দুদিক ধরে থাকবে, কুঞ্জদিদিকে ধরতে বলবে মাঝখানটা। নইলে উনি এই পেছল পথে আসতে পারবেন না। যাও—
মাঝেমাঝে বৃষ্টি সামান্য ধরে আসছে, তারপরেই আবার মুষলধারে শুরু হচ্ছে। এরই মধ্যে দেখা গেল কৃষাণদের সঙ্গে কুঞ্জপিসিমা আসছেন! দশমিনিটও তো হয়নি, কী ব্যাপার! জ্যাঠামশাই এগিয়ে গিয়ে বললেন—আরে! এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে তোমরা! আসুন দিদি, আসুন—
চরণ বলল—আমাদের পুরো রাস্তা যেতে হয়নি কর্তা। মাঝপথে গিয়েই দেখি মা-ঠাকরুন আসছেন।
বোয়াকের ধারে কাদামাখা পা ধুয়ে কুঞ্জপিসি ভেতরের বারান্দায় এসে বসলেন, বললেন-গোলোক, বৃষ্টির বহর দেখে তোমার এখানে আসবার জন্য আমি নিজেই। বেরিয়ে পড়েছিলাম। এ বৃষ্টি চার-পাঁচদিনের আগে থামবে না। পাঁচদিনের দিনও যদি থামে, তাহলেও তোমার কাজ আটকে যাবে। বৃষ্টির পর ভাল করে রোদ্র উঠতে আরা। একটা দিন লাগে, কাজেই কাদা শুকোবে না পথে-ঘাটে–
মেজকাকা বললেন-কাদা কোনো কী বলছেন, আমি তো ভাবছি একটা বন্যা-টন্যা না য়ে যায়!
কুঞ্জপিসি বললেন–কাজেই এই বৃষ্টি যেভাবেই হোক কালকের ভেতর থামা দরকার–
তারপর চারদিকে ভিড় করে আসা বৌ-ঝিদের দিকে তাকিয়ে বললেন—বৌয়েরা আর মেয়েরা, তোমাদের বলি বাচ্চারা—আমি এখন দুদিন তোমাদের বাড়ি থাকব। একবেলা দুটি আলোচালের ভাতে-ভাত ফুটিয়ে দিলেই হবে। রাত্তিরে একটুখানি দুধ। কেমন? আর বড়বৌমা, তোমার মেয়ের নীলরঙের শাড়ি আছে কি? নিয়ে এসে তো–
অকস্মাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তনে বিস্মিত হয়ে জ্যাঠাইমা বললেন—আজ্ঞে, নীলশাড়ি-মানে কেমন নীল?
যে কোনো রকম নীল হলেই চলবে, তবে হালকা বা আকাশী নীল হলেই ভাল হয়–
—অন্য রঙ হলে হবে না দিদি?
—না, নীল চাই।
সে সময়ে গ্রাম্য কিশোরী মেয়ের কটাই বা শাড়ি থাকত? তার মধ্যে নীলরঙের কোনো শাড়ি নেই। পনেরো কি কুড়ি মিনিটের মধ্যে খোঁজা শেষ। ম্লানমুখে মেজকাকিমা এসে বললেন—সিন্ধুলতার কোনো নীলশাড়ি পাওয়া গেল না দিদি। আমাদের বা অন্য কারো কাপড় হলে চলবে?
দুর্মুখ বলে গ্রামে কুঞ্জপিসিমার অখ্যাতি ছিল। মেজকাকিমার কথা শুনে তিনি রেগে গিয়ে বললেন—কী করে হবে? বিয়েটা তোমার না সিন্ধুলতার?
‘এমাঃ!’ বলে কাকিমা থতমত খেয়ে থেমে গেলেন, যদিও তিনি বুঝতে পারলেন না যার বিয়ে তার সঙ্গে শাড়ির কী সম্বন্ধ। কুঞ্জপিসিমা চোখ বুজে একটুখানি ভাবলেন, যেন ধ্যান করছেন, তারপর তাকিয়ে বললেন—আছে।
জ্যাঠামশাই গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন—কী আছে দিদি?-নীল শাড়ি আছে। আস্ত আছে কিনা জানি না, তবে আমার হাতখানেক লম্বা একটা টুকরো হলেও চলবে। সিন্ধুর পুতুলের বাক্স খুঁজে দেখ— ‘ বছরদুয়েক হল দিদি আর সেভাবে পুতুল নিয়ে খেলে না। তার পুতুলের বাক্স কোথায় পড়ে রয়েছে কে জানে। কিন্তু সবাই মিলে তোলপাড় করে খুঁজে চিলেকোঠায় ভাঙাচোরা আসবাব রাখার জায়গা থেকে সেটা বের করে আনল। প্রথমে বাক্স খুলে দেখা গেল কিছু কাঁচের রঙ্গীন চুড়ি, কাঠের আর মাটির পুতুল, সোনালি আর রূপোলি রাংতা, তাছাড়া। বাচ্চাদের খেলবার কিছু টুকিটাকি জিনিস। এসব সরিয়ে তার নিচে পাওয়া গেল এতক্ষণ যা খোঁজা হচ্ছে তাই। বাক্সের একদম তলায় চারভাজ করে পাতা হালকা নীলরঙের একটুকরো কাপড়। জ্যাঠামশাই বললেন আরে! এটা তো সেই পাঁচবছর আগে পুজোয় খুকিকে কিনে দিয়েছিলাম। আমারই তো মনে নেই, দিদি কী করে জানলেন?
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না, কেউ উত্তর আশাও করে না। কুঞ্জপিসিমা কাপড়ের টুকরোটা হাতে নিয়ে তার পাট খুলে বললেন—বাঃ, এই তত বেশ হয়েছে। এতেই কাজ চলে যাবে। হ্যাঁ, কে যেন জিজ্ঞেস করছিল নীল ছাড়া অন্য রঙে কাজ চলবে কিনা? না, তা চলবে না এই কারণে যে, আকাশের রঙ তো নীল, সেই রঙ মেঘে আর বর্ষায় ঢেকে গিয়েছে—আবার সেই নীল ফিরিয়ে আনতে হবে।
বাইরে তখনও ঝমঝম করে বৃষ্টি চলেছে। কুঞ্জপিসিমা বারান্দার ধারে এসে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জলের ধারায় কাপড়টুকু ধরে ভাল করে ভিজিয়ে নিলেন। জলে ভিজে। কাপড়ের রঙ কেমন গাঢ় হয়ে এল। আটপৌরে একটু মোটা কাপড়, টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে তার থেকে। কুঞ্জপিসিমা কিন্তু সেটা নিঙড়োলেন না, দু-আঙুলের টিপে ধরে থেকে বললেন—চট করে মাটির চারটে তাল বানিয়ে ফেল দিকি। তারপর তাতে শক্ত করে চারটে বাঁশের কঞ্চি পুঁতে দাও। এবার ওই চারটে কঞ্চিতে এই কাপড়টা টান টান করে বাঁধ। দেখতে হবে যেন ছোট্ট সামিয়ানা, বুঝেছ?
পাঁচমিনিটের ভেতর অন্দরমহলের দালানে নীল কাপড়ের খেলনা সামিয়ানা খাটানো হয়ে গেল। ঝি-চাকর-কৃষাণ সমেত বাড়ির সবাই এসে দাঁড়িয়েছে ভিড় করে। কুঞ্জপিসিমা সাধারণভাবে ভিড়টাকে উদ্দেশ করে বললেন–অর্ধেক কাজ শেষ। এই কাপড়টাকে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে ফেলতে হবে, তাহলেই আবার বরাদুর আর নীল আকাশ বেরিয়ে পড়বে। নিড়োতে পারবে না, তবে প্রয়োজন হলে পাখা নিয়ে হাওয়া দিতে পারো। এই ঘোর বর্ষায় বাতাসে জল ভরে আছে, এমনিতে শুকোতে চাইবে না। তাতে আবার মোটা কাপড়
তাঁর কথা শেষ হতে না হতে দুদিক থেকে দুজন হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতে বসে গেল। কুঞ্জপিসিমা জ্যাঠামশাইকে বললেন—গোলোক, তোমার কৃষাণ দুজনের নাম যেন কী? রামু আর চরণ, তাই না? ওদের বল একটা বেশ বড় দেখে কোলাব্যাঙ ধরে আনতে–