এই হচ্ছেন কুঞ্জপিসি। কত গল্প আছে তাকে ঘিরে।
সিন্ধুলতাকে বাড়ির ভেতরে ফেরৎ পাঠিয়ে কুঞ্জপিসি বললেন—গোলোক, তোমাকে একটা কথা বলতে এলাম। তোমার মেয়ের বিয়ে তো সামনের বুধবার, তাই না?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, আজ বুধবার, সামনের বুধবার বিয়ে। কেন দিদি?
—বিয়ের সময়ে একটু ছোটখাট অসুবিধে হতে পারে। তাই কথা বলতে এলাম—
জ্যাঠামশাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। ভবিষ্যৎবাণী করার বিষয়ে কুঞ্জপিসির খ্যাতির কথা সবাই জানে। কী অসুবিধে হবে মেয়ের বিয়েতে? এদিকে সব ঠিকঠাক, নেমন্তন্ন করাও প্রায় সারা হয়ে গিয়েছে। এখন কিছু হলে তো সমাজে আর মুখ দেখানো যাবে না। বড়মানুষ কুটুম্ব হতে চলেছে, সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে কিছু না একটা বাধা পড়ে।
জ্যাঠামশাই ভীতমুখে বললেন—কী অসুবিধে দিদি? বিয়েটা হবে তো?
কুঞ্জপিসি হেসে বললেন—সে-সব ভয় নয়। বিয়ে ঠিকই হবে, নইলে আমি জানতে পারতাম। গোলোক, তোমার যে বাদুলে মেয়ে তা জানো?
—আজ্ঞে, বাদুলে মানে-বাদুলে বলতে–
–ঝমঝম বৃষ্টির দিনে সিন্ধুলতার জন্ম হয়েছিল, মনে আছে?
—আছে। আপনি এই গাঁয়ের বৌ, আপনি তো সবই জানেন–
–ওর সারাজীবনের ভাগ্যস্থান জলবর্ষণযোগে আক্রান্ত। ঘন বর্ষায় জন্ম, অন্ন প্রাশনের দিনেও বৃষ্টি হয়েছিল—যতদূর আমার মনে পড়ছে। বিয়ের আগে-পরেও ভয়ানক বৃষ্টি হবে, একটু সাবধান থাকা দরকার।
জ্যাঠামশাই বললেন–তা বর্ষাকালে একটু-আধটু বৃষ্টি তো হবেই–
—একটু-আধটুর কথা বলছি না গোলোক। কাল কী পরশু থেকে এমন বর্ষা নামবে যে, শেয়াল-কুকুরও পথে বেরুতে পারবে না। শোলপাট্টা থেকে বর আর বরযাত্রী এসে পৌঁছবে কী করে? অমন বর্ষা হলে ছাঁদনাতলা ভেসে যাবে, রান্নার জায়গা ভেসে যাবে–
–কী করি তাহলে? তারিখ পেছোনোর উপায়ও তো নেই।
কুঞ্জপিসি বললেন–তারিখ পিছিয়ে লাভ নেই। যেদিন নতুন তারিখ ফেলবে, সেদিনই বৃষ্টিতে সব ভেসে যাবে। বাদুলে লগ্নে মেয়ের জন্ম, ওর জীবনের সমস্ত উৎসব আর বিশেষ দিনেই ভয়ানক বাদলা হবে। তবে ভয় নেই, দেখা যাক কী করা যায়–
জ্যাঠামশাই বললেন—কী করতে হবে বলুন, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
—এখন কিছুই করতে হবে না। আগে বৃষ্টি নামুক, তারপর দেখা যাবে। আমার গণনা ভুলও হতে পারে
তখনকার মত কুঞ্জপিসিমা বিদায় নিলেন। বাবা-কাকাদের মধ্যে এ নিয়ে কথাবার্তাও হল। কিন্তু কুঞ্জপিসির আশ্চর্য ক্ষমতা জানা থাকা সত্ত্বেও তার এই সাবধানবাণীতে কেউ বিশেষ ভীত হয়েছে বলে মনে হল না। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, কড়া সূর্যের আলোয় চারদিক ভরে আছে। খটখটে শুকনো পথঘাট। হ্যাঁ, কুঞ্জপিসির ক্ষমতা আছে সেটা সবাই মানছে, তবে এবার বোধহয় তার কথা ফলল না।
কেবল জ্যাঠামশাই বারবার বলতে লাগলেন—মনটা ভাল লাগছে না, বুঝলে? কি যে হয়!
বাবা আর কাকারা তাকে সাহস দিতে লাগলেন। প্রয়োজনে বরকে কাঁধে করে নিয়ে আসা হবে।
সেদিন রাত্তিরে ভেতরের বারান্দায় লম্বা সারিতে সবাই খেতে বসেছেন, কাকিমারা পরিবেশন করছেন, হঠাৎ বাড়ির বাইরে কেমন একটা ঘূর্ণিহওয়ার মত উঠল। বাড়ির উত্তর দিকের পাঁচিলের গায়ে ছিল একটা কলাগাছের ঝাড়, সে গাছগুলো একেবারে নুয়ে পড়ল বাতাসের দাপটে। খেতে খেতে জ্যাঠামশাই চমকে উঠে মুখ তুলে তাকালেন। অন্যরাও এদিক-ওদিক চাইতে লাগল। ওপাশের আমকাঠালের বাগানের ডালপালা আর পাতা কাঁপিয়ে বাতাসের প্রবাহটা ক্ৰমে মিলিয়ে গেল।
আবার খাওয়া শুরু করে জ্যাঠামশাই বললেন–হঠাৎ এমন বাতাস এল কোথা থেকে!
কেউই উত্তর দিল না। কিন্তু প্রত্যেকের বুকের ভেতরেই একটা আশঙ্কা চাপ বেঁধে রইল।
মাঝরাত্তিরের পর থেকে বাতাসের দমক যেন একটু বেশি বাড়ল। ঘুম ভাল হল না কারো।
পরের দিন সকালে উঠে সকালে উঠে দেখা গেল আকাশ ঢেকে গিয়েছে ধূসর মেঘে। সূর্যের দেখা নেই। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, সঙ্গে মাঝে মাঝে ধোঁয়ার মত গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। গতিক ভাল ঠেকছে না।
তবু সকলে আশায় বুক বেঁধে আসন্ন উৎসবের কাজকর্ম করে চলেছিল। যেন ও কিছু নয়, অমন একটু-আধটু মেঘ করেই থাকে, ও কেটে যাবে এখন। কেবল জ্যাঠামশাই কৃষাণ দুজনকে ডেকে বললেন–তোরা হরেন জানার বাড়ি চলে যা দিকি, আমার নাম করে চার-পাঁচখানা বড় আর মোটা ত্রিপল চেয়ে আনবি। ওরা বড় জোতদার, ফসল ঢাকা দেবার জন্য ওদের অনেক ত্রিপল আছে। চাইলেই দেবে’খন। যা–
তখনকার মানুষ একে অপরের বিপদে পাশে দাঁড়াত। হরেন জানা চাইবামাত্র পাঁচখানা ত্রিপল পাঠিয়ে দিলেন। পাড়ার লোক এবং কৃষাণেরা মিলে সেগুলো বাড়ির বিরাট উঠোন আর পাশে রান্না করার জায়গায় খাটিয়েও ফেলল—–যাতে এই ক-দিন ধরে ক্রমাগত জল পড়ে পড়ে উঠোন পেছল আর কাদায় ভর্তি না হয়ে থাকে। আমাদের গ্রামের মাটি সাধারণভাবে এঁটেল ধরণের, একবার কাদা তৈরি হয়ে গেলে আর দেখতে হবে না। কিন্তু এই অগ্রিম সাবধানতা বিশেষ কাজে লাগল না। সারাদিন ধরেই হাওয়ার জোর বাড়তেই লাগল, বিকেলের দিকে মেঘের ছায়ায় চারদিক ঘোর কালো হয়ে গেল, বৃষ্টি নামল ঝমঝম করে। আকাশপাতাল ভাসিয়ে এই প্রলয়ের বৃষ্টি চলল সারারাত বাড়ির কারো রাত্তিরে ঘুম হল না। পরদিন ভোর হল বটে, কিন্তু আলো ফুটল না ভাল করে। সমস্ত গ্রাম একটা বিশাল কাদার দহ হয়ে আছে। ভয়ঙ্কর পেছল এঁটেল মাটির কাদা। এই কাদা থাকলে বাইরের অতিথি দূরের কথা, গ্রামের লোকের চলাচলই বন্ধ হয়ে যাবে।