বুঝলাম বাবা আর যথেষ্ট রাগ করতেও পারছেন না। ক্লান্ত গলায় তিনি বললেন–তুমি কী যে মাঝে মাঝে বল তার কোন মানে হয় না। কীসের চার হাত কম?
-ও একটা হিসেব, আপনাকে বোঝাতে পারব না। নিন, শুরু করতে বলুন—
ভিতে প্রথম শাবলের ঘা পড়তেই আমরা সবাই ঘন হয়ে ভিড় করে গদাধরকে ঘিরে দাঁড়ালাম। গদাধর আলতো করে গাঁথুনির জোর আগা করছে, আর আমরা রুদ্ধনিশ্বাসে অপেক্ষা করে আছি। তিনসারি ইট খসাতেই ভিতের ভেতরে একটা চতুষ্কোণ গহ্বর বেরিয়ে পড়ল। শাবল রেখে তার মধ্যে হাত গলিয়ে গদাধর বের করে আনল অপূর্ব সুন্দর গঠনের এক দেবমূর্তি। এতদিন অবহেলায় পড়ে থেকেও তার ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হয়নি। প্রায় একহাত লম্বা বিগ্রহ, মাথায় ছত্র, মুখে হাসি। আগেই তো বলেছি, আমি তখন খুব ছোট, শিল্পের রস পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করার বয়েস তখনো হয়নি। তবু মূর্তিটা দেখামাত্র মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম মনে আছে।
বাবা গদাধরের হাত থেকে মূর্তিটি নিয়ে দুই হাতে মাথায় ধরে বলতে লাগলেন—জয় শ্রীবিষ্ণু! জয় শ্রীবিষ্ণু! দেবতা ফিরেছেন! কাকারা তার সঙ্গে বলতে লাগলেন—জয়! জয়! কাকিমারা উলু দিয়ে উঠলেন। বাবা বিষ্ণুমূর্তি মাথায় করে বাড়ির মধ্যে নিয়ে চললেন। সেটি তখনকার মত ঠাকুরঘরে রাখবার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল, মেয়েরাও ভেতরে চলে গেলেন।
অমরের হাত ধরে বাবা বললেন—ভাই, তুমি আমাকে মার্জনা কর। জানি না তুমি কে, কোথা থেকে এসেছ—জানতেও চাই না। তোমার আশ্চর্য ক্ষমতার কথা আমি স্বীকার করলাম। যদি খারাপ ব্যবহার করে থাকি, তা মনে রেখো না।
সকলের অনুরোধেও অমর সেদিনটা আর থাকতে রাজি হল না। বাবা শেষে বললেন—তাহলে কী এই ধরে নেব যে, তুমি আমাকে মার্জনা করলে না?
—ছিঃ, ও কথা বলবেন না। আমি এইরকমই ভবঘুরে ধরণের, একজায়গায় দুদিন থাকতে ভাল লাগে না। তবে একটা কথা বলে যাই, আপনাদের বংশ খুব পবিত্র এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদপূত বংশ। এক পুরুষ বাদ দিয়ে দিয়ে এই বংশে একজন করে সাধক জন্মগ্রহণ করবেন। আপনার ভাই তো সন্ন্যাসী হয়েই গিয়েছেন, এর পরের পুরুষে নয়, এখন যারা ছোট—এই এরা—এদের কারো সন্তান অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে। সংসারে থেকেও সংসারী হবে না। আপনি তার জন্ম বৃদ্ধবয়সে দেখে যেতে পারবেন
বাবা বললেন কী করে বুঝব সে কে?
–তার জন্মের সময়ে আকাশে এক আশ্চর্য নীল উল্কাপাত হবে। নীল রঙের আলোয় ভরে যাবে চারদিক। এখনো অবশ্য তার দেরি আছে। মনে রাখবেন কথাটা। আচ্ছা, চলি তাহলে–
উঠোন পেরিয়ে, সদর দরজা পেরিয়ে অমর চলে গেল। সঙ্গে সে একটা রহস্যের পরিবেশ নিয়ে এসেছিল। সে চলে যাবার পরও সেটা কিন্তু থেকেই গেল।
পনেরোই ফাল্গুন সকাল থেকে বাড়ির সবাই ঠাকুমার দিকে সতর্ক নজর রেখে বসে রইল। অমরের ভবিষ্যৎবাণী তাকে কেউ জানায় নি। তিনি ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে বাগানে ঘুরে ঘুরে ঠাকুরপূজোর জন্য ফুল তুললেন, তারপর পূজোয় বসলেন। পূজো হয়ে গেলে উপুড় হয়ে গৃহদেবতাকে প্রণাম করলেন।
এবং আর উঠলেন না। প্রণামরত অবস্থাতেই তার মৃত্যু হল।
দাহ সেরে সন্ধেবেলা বাবা-কাকারা বাইরের ঘরে এসে বসেছেন, পাড়ার লোকেরাও একজন দুজন করে আসছেন। এমনসময় মাধব চৌধুরী ঘরে ঢুকে বললেন—আহ্নিক সেরে আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। ওহে রামনাথ, বাইরে কে একজন তোমাকে ডাকছে। আমাকে বললে—গিয়ে বলুন আমি এসেছি। আমার নাম অমর, আসবার কথা ছিল আজ। কে হে লোকটা? এ গ্রামে দেখেছি বলে তো মনে হল না—
বাবা প্রায় লাফিয়ে উঠে বাইরে গেলেন। কেউ নেই। কেউ না। কেবল ঝিমঝিম করছে আসন্ন রাত্রির আবছা অন্ধকার।
০৩. একটানা এতক্ষণ কথা বলে
একটানা এতক্ষণ কথা বলে আদিনাথ চক্রবর্তী একটু থামলেন। বর্ষণমুখর রাত্রির জলভেজা বাতাস ক্রমাগত দুলিয়ে চলেছে ঝুলন্ত লণ্ঠনটা, সেইসঙ্গে দেয়ালে নড়ছে ঘরে বসে থাকা মানুষদের ছায়া। আড্ডায় মাঝে মাঝে একটা সময় আসে যখন হঠাৎ সবাই একসঙ্গে চুপ হয়ে যায়। জমাট গল্পেরও একটা মহিমা আছে। সে গল্প সত্য, মিথ্যা বা অবিশ্বাস্য যাই হোক না কেন, ভাল করে বলতে পারলে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়। আদিনাথ কথক হিসেবে প্রথম শ্রেণীর, নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়কেও বলার গুণে মনোমুগ্ধকর করে তুলতে পারেন। আজ রাতের পরিবেশ আর তার গল্প এমন খাপ খেয়ে গেল যে, আচ্ছাধারীরা কেউ কোনো তর্ক তুলল না। কেবল সরসী চাটুজ্জে বললেন-আপনার ঠাকুমার মৃত্যুবিষয়ে ওই ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাওয়াটা অবশ্য আমি খুব আশ্চর্য কিছু বলে মনে করছি না, কারণ এই কথাটা বাড়ির কেউ নিশ্চয় তাঁকে মুখ ফসকে বলে ফেলে থাকবে। ফলে আপনার ঠাকুমা মনের দিক দিয়ে পনেরোই ফায়ুন তারিখের প্রসঙ্গে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বয়েস অনেক হয়েছিল, কাজেই ওই বিশেষ তারিখে হয়ত মানসিক উত্তেজনা সামলাতে পারেন নি। তার মনই তাকে নির্দেশ দিয়েছিল দেহরক্ষা করতে। এমন হয়, আমি শুনেছি। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া বিষ্ণুমূর্তি ফিরে পাওয়াটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তাছাড়া সবকিছুর যে ব্যাখ্যা থাকতেই হবে তার কী মানে আছে। কিছু কিছু আবছা আড়াল থাক না, তাতে জীবন সরস হয়ে ওঠে।
রাম গাঙ্গুলি বললেন—সব জিনিসের ব্যাখ্যা হয় না। আমার আপন ভায়রাভাই। তার মামাবাড়ির গ্রামে নিজের চোখে আঁতুড়ের ছেলেকে হেঁটে বেড়াতে দেখেছে, জানো? সে অত্যন্ত সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ, অকারণে মিথ্যে কথা বলবে না। সদ্যোজাত ছেলে—সবে নাড়ি কাটা হয়েছে—সে হাঁটছে আর খিলখিল করে হাসছে। আচ্ছা। ভায়রাভাইয়ের কথা না হয় বাদই দাও, আমার ছোটবেলায় আমি এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছি যা শুনলে তোমরা বিশ্বাসই করবে না।