কত বছর আগের কথা, তবু এখনো সে দৃশ্য স্পষ্ট মনে আছে। সেই আমাদের চকমিলাননা ঠাকুরদালান, বাবা-কাকা, মা-কাকিমারা আর কর্মচারীর দল ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনে শীতসকালের সোনারঙ রোদ্র এসে পড়েছে। সে উঠোনে কীসের যেন দানা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে গোলা পায়রার দল। অতগুলো লোক দাঁড়িয়ে, কেউ কথা বলছে না।
দেখলাম ঠাকুমার মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে উঠেছে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলে ঠিক অমন করে হাসে। দু-চার মিনিট হাসিটা রইল, তারপর ধীরে মিলিয়ে গেল। ঠাকুমা আবার শান্ত, সমাহিত, বাহ্যিক কোনো আবেগশূন্য।
অমর মৃদুগলায় ডাকল–মা, এবার জাগুন। দেখা হয়েছে তো? এবার তাকান—
আস্তে আস্তে ঠাকুমা চোখ খুললেন। যেন একটু অবাক হয়ে চারদিকে তাকালেন, কোথায় রয়েছে বুঝতে না পারলে মানুষ যেমনভাবে তাকায়। তারপর সামনে অমরকে দেখে তার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অমর বলল—হয়েছে মা?
ঠাকুমা বললেন—হ্যাঁ বাবা, হয়েছে।
বাবা ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কী দেখলে মা? ছোটুকুকে দেখতে পেলে?
সে কথার উত্তর না দিয়ে ঠাকুমা বললেন—বৌমারা আমাকে ধরে ভোলো, আমি ঘরে যাব। ঘরে দিয়ে এসো–
দু’পা গিয়ে পেছন ফিরে তাকালেন ঠাকুমা। অমরের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন-আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছি তুমি কে। আবার এসো মাঝে মাঝে
অমর বলল–আসব মা, মাঝে মাঝে আসব।
ঠাকুমা চলে গেলে বাবা বললেন—এ কী উৎপাত! কী চাও তুমি? তুমি কে?
অমর এবার মুখ তুলে বেশ ব্যক্তিত্ব মেশানো গলায় বলল—দেখুন, আমি একজন সাধারণ মানুষ। পথেঘাটে ঘুরে বেড়াই। আপনি কী আমাকে অবিশ্বাস করছেন? আমি তো আপনার কাছে কিছু চাইনি—কেবল এক রাত্তিরের আশ্রয় ছাড়া। তাহলে?
মাকে তুমি কী দেখালে? মাও তোমাকে কী বলে গেলেন বুঝলাম না। এর মানে কী?
-কিছুই না। উনি বুড়ো মানুষ, ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় ওঁর মনে দুঃখ রয়েছে, সে দুঃখ মা ছাড়া কেউ বোjhe না। ওঁকে যদি একটু আনন্দ আর স্বস্তি দিতে পেরে থাকি, তাতে কী ক্ষতি হয়েছে বলুন?
-তা নয়, কিন্তু মাকে কেন হঠাৎ-মানে, বলছি যে—
হঠাৎ নয়। কারণ আছে। বললে যদি রাগ না করেন তাহলে বলতে পারি।
বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন-বল। রাগ করার মত কথা নিশ্চয় বলবে না।
–আপনার মা আর বেশিদিন বাঁচবেন না।
–সে তো জানা কথাই। উনি বুড়ো হয়েছেন, পঁচাশি বছর বয়েস। এটা আর তুমি নতুন কথা কী বললে? যাই হোক, তাতে কী?
অমর বলল—আজ পৌষ মাসের তিন তারিখ। এই ফাল্গুন মাসের পনেরোই শুক্ল ত্রয়োদশীর দিন সকালে উনি চলে যাবেন। ছেলের খবর জানতে পারলেন না এই কষ্ট নিয়ে যেতেন, তাই ওঁকে একটু আনন্দ দিয়ে গেলাম।
বাবা রেগে উঠে বললেন—তুমি তো অদ্ভুত লোক! আমার বাড়িতে অতিথি হয়ে আমারই মায়ের মৃত্যুর কথা বলছ? জানো, তোমাকে আমি ইচ্ছে করলে অমর হেসে বলল—এই দেখুন, আপনি রাগ করবেন না বলে কথা দিয়েও রাগ করছেন। আপনাদের সবাইকে রেখে ভগবানের নাম করতে করতে মা পুণ্যবতীর মত চলে যাবেন, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? দেহধারণ করলে একদিন ছেড়ে যেতে হয়। কেউই চিরজীবী না। আর আমার এ কথা যদি না ফলে, তাহলে তো ভালই। প্রাণভরে আমাকে তখন গালাগাল দেবেন।
বাবা বললেন তুমি আমাকে দেখাতে পারো? আমি যদি ছোটকুকে দেখতে পাই তাহলে বিশ্বাস করি। পারো দেখাতে?
–দেখুন, আপনাকে বিশ্বাস করাবার কোনো দায় আমার নেই। আপনি আমাকে অবিশ্বাস করলে তাতে আমার কিছু এসে যাবে না। অকারণে শক্তির অপব্যয় করতে নেই।
–তার মানে তোমার মধ্যে কোথাও ফাঁকি আছে। তুমি চালাকি করছ।
অমর বলল আপনার মা কিন্তু তা মনে করেন না। আচ্ছা, একটা কাজ করা যাক। আপনার বংশের একটা হারানো জিনিসের সন্ধান আপনাকে দিয়ে যাই। তাহলে হয়ত আমাকে আর পুরোপুরি জোচ্চোর বলে মনে হবে না। কেমন?
বাবা ধরা গলায় বললেন—কী জিনিস?
—তিন-চারপুরুষ আগে আপনাদের বংশে একটা অষ্টধাতুর বিষ্ণুমূর্তি ছিল, জানেন কী?
বিস্মিত হয়ে বাবা বললেন—হ্যাঁ, ঠিক কথা। তিন বা চারপুরুষ কেন, আরো বহু-বহু আগে থেকে সে মূর্তি আমাদের গৃহদেবতা হিসেবে পূজো করা হত। কিন্তু বর্গীর হাঙ্গামার সময় সে মূর্তি আমার পূর্বপুরুষেরা কোথাও লুকিয়ে ফেলেন, অথবা হারিয়ে যায়। আর পাওয়া যায় নি। তুমি তুমি কী বলতে চাও?
—আমি জানতে পেরেছি সে মূর্তি কোথায় আছে। আপনার লোকদের কারুকে বলুন একটা শাবল নিয়ে আমার সঙ্গে আসতে। আপনারাও আসুন।
ঠাকুরদালান থেকে নেমে দেউড়ির ভেতর দিয়ে অমর উঠোনে গিয়ে নামল, তার পেছনে পেছনে বাড়ির সবাই মিছিল করে চললাম। অমর এমনভাবে হাঁটছে যেন সে একেবারে নিশ্চিতভাবে জানে কোথায় যেতে হবে। বাড়ির উত্তর ভিতের কোণায় এসে সে থামল। গদাধর নামে আমাদের একজন কর্মচারীর হাতে ছিল শাবল। অমর তাকে বলল—এইখানে ভিত খোঁড়ো।
গদাধর বাবার দিকে তাকাল। বাবা অমরকে বললেন কতটা খুঁড়তে হবে?
–মাটি নয়, দেয়ালের গা থেকে তিন-চারটে করে ইট খসাও। এই জায়গায়—
বাবা বললেন—সে কী কথা! ভিতের ইট খসালে বাড়ির ক্ষতি হবে না?
—কিচ্ছু হবে না। কয়েকটা ইট মাত্র। কালই রাজমিস্ত্রি ডেকে গাঁথিয়ে নেবেন।
–কিন্তু এখানটাতেই খুঁড়তে হবে কেন?
—কারণ এ বাড়ি উত্তরে উঁচু, আর এখানেই উত্তর ভিতের শেষ। এখানে শ্রীবিষ্ণু রয়েছেন বলেই এদিকটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে যায়নি। জানেন তো, যে জমির ওপর বাড়ি তৈরি, তার রকম অনুযায়ী পঞ্চাশ, একশো কী দেড়শো বছরে ভিত সামান্য। কিছুটা বসে যায়। আপনাদের বাড়িতেও তাই হয়েছে। কেবল বিষ্ণুর অধিষ্ঠানের জন্য উত্তর দিক সামান্য উঁচু। তাছাড়া বেয়াল্লিশ হাত হল না তো, সদর দরজা থেকে আটত্রিশ হাত মাত্র হল। তাই এখানেই নিশ্চয় থাকবে। নইলে আরো চারহাত ওদিকে হত—