কিন্তু কথা হল, লোকটি ট্রেনে উঠল কখন? হাওড়া থেকে গাড়ি ছাড়ার সময় পর্যন্ত কামরায় আমি, নির্মলবাবু আর সেই ভোজনরত অবাঙালী ভদ্রলোক ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। গাড়িতে ঠিক গভীর ঘুম হয় না, আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে চাকার শব্দ, লাইনের ক্রসিং পার হবার ঘটাং ঘটাং আওয়াজ, কামরার দুলুনি—সব অস্পষ্টভাবে টের। পাওয়া যায়। কাজেই আমি জানি ট্রেন মধ্যে কোনও স্টেশনে থামেনি। থামলে টের পেতাম। তা হলে?
অথবা থেমেছে নিশ্চয়ই, হয়তো মাঝখানে একটু গভীর ঘুম হওয়ায় বুঝতে পারিনি। নইলে আস্ত একটা মানুষ তো বাতাসে উড়ে এসে কামরার জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েনি!
এইসব ভাবছি, গাড়ি ঢুকে পড়ল খঙ্গপুর স্টেশনে।
এত রাত্তিরে প্ল্যাটফর্মে ভিড় ছিল না। দু-একজন ঝিমন্ত চা-ওয়ালা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই কামরায় কেউ উঠল না। নির্মলবাবু ঘুমের মধ্যেই একবার বিড়বিড় করে বললেন—কী স্টেশন?
বললাম-খড়গপুর।
‘বাঃ বাঃ, বেশ!’ বলে নির্মলবাবু পাশ ফিরে আবার গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন।
ট্রেন ছাড়তে আমিও আরাম করে শুয়ে চোখ বুজলাম।
পরের বার ঘুম ভাঙল ট্রেন থামার সামান্য ঝাঁকুনিতে : রাত তখন সওয়া তিনটে। দেখলাম ছোট একটা স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। আমাদের কামরার ঠিক সামনেই লোহার খুঁটির ওপর তেলের বাতি জ্বলছে, যদিও চমৎকার জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করছে, বাতির কোনও দরকার নেই, তবু সরকারী আইন—গাড়ি আসবার দশ-পনেরো মিনিট আগে স্টেশনের কুলি এসে বাতি জ্বেলে দিয়ে যায়। সারারাত টানা জ্বলে না, তাতে সরকারের অকারণ খরচ বাড়ে। মাথায় পাগড়ি, গায়ে লাল কুর্তা পরা রেলের এক কুলি কামরার পাশ দিয়ে গম্ভীর হেঁড়ে গলায় বলতে বলতে চলেছে—গৈলকেরা। গৈলকেরা–
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম—কী স্টেশন এটা, ও ভাই?
সে হাঁটতে হাঁটতেই বলল–গৈলকেরা, বাবুজি।
মেজকর্তা ঠিকই বলেছিলেন, ভারি অপূর্ব দৃশ্য তো এ লাইনের! স্টেশনের একেবারে গা ঘেঁষে একটা বনজঙ্গলে ভর্তি পাহাড় উঠে গিয়েছে ওপরদিকে। প্ল্যাটফর্মে জনমানব নেই, পরিবেশে কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই, কেবল চাদের আলোয় হাল্কা স্বপ্নের রঙ দিয়ে আঁকা একখানি দক্ষ শিল্পীর তৈরি ছবি আমার সামনে মেলে রাখা আছে। হঠাৎই নৈশ মগ্নতা ভেঙে সামনের পাহাড়ের জঙ্গল থেকে কর্কশ গলায় কী একটা প্রাণী ডেকে উঠল। অবাক হয়ে ভাবছি, জিনিসটা কী হতে পারে, এমন সময় আমার পেছন থেকে নির্মলবাবুর গলা ভেসে এল—ময়ুর! ওটা ময়ুরের ডাক–
পেছনে তাকিয়ে দেখি সার্ভেয়ার সাহেব ঘুম ভেঙে উঠে বসেছেন।
বললাম–হ্যাঁ। প্রথমে বুঝতে পারিনি, তারপরে মনে পড়ল কলকাতার চিড়িয়াখানায় এই ডাক শুনেছি। শহরের লোক তো, একটু ধাঁধা লেগে যায়। আপনি কী করে বুঝলেন?
একটা হাই চেপে সার্ভেয়ার সাহেব বললেন—সিনেমা দেখে।
—সিনেমা দেখে। তার মানে?
—আরে মশাই, আমিও আপনার মত শহরের মানুষ, ময়ূরের ডাক রোজ শুনব কোথা থেকে? গত মাসে ভক্ত ধ্রুব ফিলিম দেখতে গিয়েছিলাম, তাতে একটা দৃশ্যে রয়েছে ধ্রুব জঙ্গলে চোখ বুজে বসে ধ্যান করছে, আর তার চারদিকে চরে রেড়াচ্ছে কটা ময়ূর। তারই মধ্যে একটা কয়েকবার ক্যাক ক্যাক করে ডাকল। কিন্তু সে আওয়াজে ধ্রুবর ধ্যান ভাঙল না, ডিরেকটার সেই ব্যাপারটাই দেখাতে চেয়েছিলেন। সেটা মনে পড়ে গেল–
নির্মলবাবু উঠে এসে আমার বেঞ্চিতেই জানালার ধারে বসলেন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন–নিন।
একসঙ্গে বাইরে বেরুলে একটা সহজ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে পদমর্যাদা কিংবা সামাজিক। অবস্থানের পার্থক্যটুকু মুছে দেয়। তবু অফিসে নির্মলবাবু আমার ওপরওয়ালা, উনি দিচ্ছেন বলেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে একটা তুলে নেওয়া যায় না। সসঙ্কোচে বললাম-না, থাক–
—থাক কেন, নিন-ধরান একটা। এখন আমাদের বেশ কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে হবে। লজ্জা ঝেড়ে না ফেললে চলবে কী করে? আপনি স্মোক করেন তা আমি জানি–
ক্যাভেন্ডার্স নেভিকাট একখানা ধরিয়ে মাথা সোজা করতেই প্রথম নজর পড়ল ওপাশের বেঞ্চিতে। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
সেই মাঝপথে হঠাৎ উঠে আসা রহস্যময় লোকটি আর সেখানে নেই।
আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে নির্মল কাঞ্জিলাল একবার ওপাশে তাকালেন, তারপর বললেন—কী হয়েছে? ওদিকে অমন করে কী দেখছেন?
বললাম–না, মানে-ওই ওদিকের বেঞ্চিতে একজন লোক শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, সে গেল কোথায়?
নির্মলবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—মাঝে কোনও স্টেশনে নেমে গিয়েছে হয়তো। জিনিসপত্র কিছু নিয়েটিয়ে যায়নি তো? দেখে নিন ভাল করে, দিনকাল খারাপ পড়েছে–
—না, ঠিক তা নয়, মানে—
বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে বেশি কথা বললে নির্মলবাবু হয়তো আমাকে বাতিকগ্রস্ত ভাববেন। কথার গতি বদলে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললাম—কী অপূর্ব দৃশ্য, তাই না? মেজকর্তা ঠিকই বলেছিলেন, বাকি রাতটুকু আর। ঘুমোনা উচিত হবে না–
নির্মল কাঞ্জিলাল মানুষ ভাল, কিন্তু একটু বাস্তববাদী নীরস প্রকৃতির। ক্যাভেন্ডার্সে একটা লম্বা সুখটান দিয়ে জানালা গলিয়ে অবশিষ্টাংশ বাইরে ফেলে আবার শোয়ার উদ্যোগ করতে করতে তিনি বললেন—আপনাদের মনে অসীম কবিত্ব, জেগে বসে প্রকৃতি দেখুন বরং, আমি আরও ঘণ্টাদুই ঘুমিয়ে নিই। রাউরকেল্লা ঢোকবার মুখে ডেকে দেবেন। মেজকর্তা অমন করে বললেন, তাঁর মুখের ওপর তো আর ‘না’ বলা যায় না। কিন্তু আমার ঘুমই ভাল–