গাড়িতে উঠে সুটকেসটা বাঙ্কে তুলে দিয়ে হোল্ড-অল খুলে বেঞ্চিতে বিছানা পাততে পাততে বললাম—মেজকর্তা তো সেকেন্ড ক্লাসে যাবেন, তিনি এসেছেন তো?
-ওঃ, সে আমাদের আগে! মহা ব্যস্তবাগীশ মানুষ, এরমধ্যেই দুবার এসে আপনি পৌঁছেছেন কিনা সে খোঁজ নিয়ে গিয়েছেন। একটু খামখেয়ালি, কিন্তু ভাল লোক— এ নির্মলবাবুর কথা শেষ হতে না হতে মেজকর্তা ফের এসে হাজির। জানালায় উঁকি দিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—যাক্, এসে গিয়েছেন। আপনারা মশাই ইয়ং ম্যান, আপনাদের এত দেরি হয় কী করে বলুন তো?
সবিনয়ে জানালাম-খাওয়াদাওয়া করে বেরুতে একটু সময় লেগেছে।
—এঃ হে, খেয়ে এসেছেন! ট্রেন জার্নির আদ্দেক মজাই তো মাটি করেছেন! শুকনো খাবার—যেমন পরোটা, রুটি, সামান্য সবজি, গুটিকয়েক কড়াপাকের সন্দেশ—এইসব নিয়ে ট্রেনে উঠবেন। গুটগুট করে ট্রেন চাবে, আর টুকটুক করে খাবেন। তবে না মজা! তারপর গলার স্বর নিচু করে ওদিকের বেঞ্চিতে ভোজনরত অবাঙালী ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন—ওই দেখুন একজন বুদ্ধিমান লোক। গলার স্বর আবার স্বাভাবিক করে হেসে বললেন—এই দেরি করে খাওয়া সারতে গিয়ে কত লোক ট্রেন মিস্ করে। যাক্, আবার যেন নামতে দেরি করবেন না। আলো ফোটবার আগেই গাড়ি রাউরকেল্লা ঢুকে যায়। বাঙামুণ্ডা পার হতে আরম্ভ করলেই জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবেন–
বললাম–ভয় কী। এ ট্রেন তো রাউরকেল্লা ছাড়িয়ে আর যাবে না–
মেজকর্তা হেসে বললেন—তা ঠিক। আর একটা কথা, টাটানগর ছাড়াবার পর লাইনের দুদিকের দৃশ্য খুব সুন্দর, কেবল পাহাড় জঙ্গল আর ঝর্ণা। চাঁদনি রাত এখন, দেখতে খুব ভাল লাগবে। আজকে রাত দুটোর পর আর ঘুমোবেন না—
মানুষটার ওপর শ্রদ্ধা জন্মে গেল। অফিসের একঘেয়ে আর নীরস কাজের মধ্যে মেজকর্তার এই সরস ব্যক্তিত্বের দিকটা চোখে পড়ার কোনও সুযোগ ঘটেনি। বরং তার। খামখেয়ালিপনা নিয়ে আড়ালে আমরা সকলে হাসাহাসিই করেছি। কার মধ্যে যে কী। থাকে!
ট্রেন ছাড়ল। রেলের গুমটি, শান্টিং ইয়ার্ড ইত্যাদি ছাড়াবার পর গতি বাড়িয়ে ট্রেন জোরে ছুটতে শুরু করল। প্রথম থামবে একেবারে খঙ্গপুরে। কিন্তু এখন সত্যিই দুদিকে দেখবার কিছু নেই। অতি সাধারণ কিছু কুশ্রী জনপদ, দোকানপাট বন্ধ, পথে মানুষ প্রায় নেই। বিদ্যুতের আলো কম, তেলের বাতি জ্বলছে কোথাও কোনও বাড়ির বারান্দায়। বড় শহরের উপকণ্ঠ যেমন নিরানন্দ আর নীরস হয়। মেজকর্তার কথা মেনে রাত দুটোর পর জাগলেই হবে এখন। মাথার পেছনে দুইহাত দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে কামরার ছাদে কম পাওয়ারের বাতিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ট্রেনের দুলুনিতে আস্তে আস্তে ঘুম পেয়ে গেল।
ঘণ্টা আড়াই পরে ঘুমটা আপনিই ভেঙে গেল। ঘড়িতে দেখি রাত প্রায় একটা। তার মানে সামনে খড়গপুর আসছে। কনুইয়ে ভর দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। চাদের আলোয় ধোয়া মাঠপ্রান্তর দ্রুতবেগে পেছনদিকে ছুটে চলেছে, মৃদু আলোয় দৃশ্যমান। পরিবেশে ফুটে রয়েছে এক দৈবী মায়া। এখনও এক কী দেড়ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়ে উঠলেই হবে। আবার শুয়ে পড়তে যাচ্ছি, হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আকাশের অনেকখানি অংশে দীর্ঘ পথরেখা টেনে চন্দ্রালোকিত মাঠে এক বিশাল নীল উল্কা এসে পড়ল! আকাশে তার সঞ্চরণপথে এখনও আবছা নীল আভা জেগে রয়েছে। দুরন্ত গতিতে ছুটে এসে মাঠে পড়ার প্রচণ্ড অভিঘাতে বোধহয় উল্কাটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল, একরাশ নীল আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে উঠল মাঠের বুক থেকে। স্কুলের পাঠ্যবইতে পড়েছিলাম প্রতিদিনই বহু উল্কা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, কিন্তু তার ভেতর খুব কমই মাটি পর্যন্ত পৌঁছায়। আমিও এই প্রথম কোনও উল্কা মাটিতে পড়তে দেখলাম। তাছাড়া উল্কা কি কখনও নীল রঙের হয়? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল একটা কথা—বহুদিন আগে তারানাথ কালভৈরবের উপাখ্যান শোনাবার সময় বলেছিল তার জন্মমুহূর্তে নাকি বিশাল এক নীল উল্কা আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি চলে গিয়েছিল ঠিক এমনি পথরেখা তৈরি করে। এবার যে গল্প অসমাপ্ত রেখে বাইরে যাচ্ছি—ফিরে নিশ্চয়ই বাকিটা শুনব—তাতেও তারানাথ একবার এই ব্যাপারটার উল্লেখ করেছিল বলে মনে পড়ল। এই দুটো ঘটনার কি কোনও যোগসূত্র আছে? নইলে আজই হঠাৎ নীল উল্কাপাত দেখলাম কেন?
অবশ্য একটা কথা ঠিক, এর আগে খুব একটা বাইরে বেরুই নি কখনও। গ্রামের পাঠশালা সাঙ্গ করে মহকুমা শহরে হোস্টেলে থেকে পড়তাম। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতার কলেজ, তারপর কলকাতাতেই চাকরি। আমি সত্যেন দত্ত বা নজরুলের কবিতার বাংলার দামাল ছেলে নই, সেভাবে দেখা হয়নি কিছু। জীবনে প্রথম গৃহপ্রাঙ্গণ পার হয়ে বেরুতে না বেরুতে একটা বিচিত্র জিনিস দেখে ফেললাম। এমনই অভিজ্ঞতার জনক!
আবার শুয়ে পড়তে যাচ্ছি, হঠাৎ নজরে পড়ল ওধারের বেঞ্চের দিকে।
সেখানে একজন মানুষ শুয়ে ঘুমোচ্ছ। ঘুমোচ্ছে বললাম বটে, কিন্তু নিদ্রিত লোকের দেহে এক ধরনের অচেতন শিথিলতা থাকে-একে দেখে মনে হয় যেন এমনি এমনি চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে। বছর চল্লিশেক বয়েস হবে, পরনে খাটো ধুতি আর ফতুয়া বা পিরাণ জাতীয় কিছু। মুখশ্রী শান্ত আর নিরীহ, সে মুখে এমন একটা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার জন্য বারবার তাকাতে ইচ্ছে করে। যদিও লোকটি একটু ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকায় সম্পূর্ণ মুখটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছি না।