বাবা ক্রমেই আরো অবাক হয়ে যাচ্ছেন। বললেন—ঠিক।
বাড়ির মেয়েরা থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ঠাকুমা এতক্ষণ বাড়ির ভেতরে ছিলেন, তখন তিনি বেশ বৃদ্ধা, তাকেও নিয়ে আসার জন্য একজন কাকিমা চলে গেলেন। আমি অমরের দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যিই তো, আমরা যাকে ছোটকাকা বলি, তিনি আসলে বাড়ির ছোটছেলে নন। আমাদের ছোটকাকা কৈশোরেই উদাস প্রকৃতির ছিলেন, পনেরো বছর বয়েস পূর্ণ হতে যখন আর মাত্র কয়েকদিন বাকি, তখন একবস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তাকে আমরা কখনো দেখিনি, সে সময় বাবা বা অন্য কাকাদের বিয়ে হয়নি। আসলে আমরা সেজকাকাকে বর্তমানে ছোটকাকা বলে ডেকে থাকি। ছোটকাকার গৃহত্যাগের গল্প আমরা শৈশব থেকে শুনে আসছি। সে সময় গ্রামে সারারাতব্যাপী যাত্রার আসর বসত। ঝুলন পূর্ণিমা উপলক্ষে গাঁয়ে নিমাইসন্ন্যাস পালার আয়োজন করা হয়েছে, নবদ্বীপ থেকে খাস নারায়ণ অধিকারীর দল আসবে। লোকের মধ্যে সাজো সাজো রব। শুনেছি এই দলের যে নিমাই সাজত, তার অভিনয় দেখে দর্শকরা উম্মত্তের মত হরিধ্বনি দিয়ে দুহাত তুলে নাচতে শুরু করত। কিছুক্ষণের জন্য যাত্রার আসর সত্যি সত্যিই সংকীর্তনের আসর হয়ে উঠত। ওই অভিনয় দেখে ছোটকাকা পরের দিন সকালে আর বাড়ি ফিরলেন না। কোথায় যে গেলেন কে জানে। সে যুগে যতটা সম্ভব খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল, কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তারপর যেমন হয়, যন্ত্রণার ওপর একটু একটু করে সময়ের পলি জমে কষ্টটা কমে এল। কেবল ঘটনাটা একটা পারিবারিক পুরনো গল্প হয়ে রইল।
–রাম! রাম কই? অ রাম!
ঠাকুমাকে ধরে আনছেন মেজকাকিমা। বাবার নাম রামনাথ, তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন কী মা? এই যে, আমি এখানে—তিনি এগিয়ে গিয়ে ঠাকুমার হাত ধরে দাঁড়ালেন।
—মেজবৌমা কী বলছে রাম? ছছাটুকুর খবর নাকি পাওয়া গিয়েছে?
বৃদ্ধার চোখে আগ্রহের ঔজ্জ্বল্য। বাবা একটু আমতা আমতা করে বললেন—এই যে এই লোকটি—ওর নাম অমরজীবন, ও কাল থেকে আমাদের বাড়ি অতিথি—ও নাকি স্বপ্ন দেখেছে ছোটুকু বেঁচে আছে, ভাল আছে। তুমি দাঁড়িয়ে কাপছ কেন? বোসো এইখানে
ঠাকুমা বাবার কথায় হৃক্ষেপ না করে অমরের দিকে তাকিয়ে বললেন—তুমি কে বাবা?
ঠাকুমাকে দেখে অমর দাঁড়িয়ে উঠেছিল, এবার এগিয়ে এসে প্রণাম করে বলল—মা, আমার নাম অমর। আমিও আপনার এক ছেলে–
গতকাল অমর কিন্তু বাবাকে প্রণাম করেনি, সাধারণ ভদ্রতা এবং বিনয় বজায় রেখে কথা বলেছিল বটে, কিন্তু ভক্তিতে গলে পড়ে আদিখ্যেতা করেনি। অথচ বাবা খুব রাশভারী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। লোকে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস পেত না। ঠাকুমাকে দেখে অমর প্রথমে উঠে দাঁড়াল, তারপর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। কেন যেন তার এই আচরণ আমার খুব সুন্দর বলে মনে হল।
ঠাকুমা বললেন—তুমি জানতে পেরেছ ছোট্কু বেঁচে আছে? ভাল আছে?
—হ্যাঁ মা।
–কী করে জানলে? একটু চুপ করে থেকে অমর বলল–মা, আমি ঠক-জোচ্চোর কিম্বা ধর্মের ব্যবসাদার হলে বলতাম—বিশেষ ক্ষমতায় ডাকিনী যোগিনীকে বশ করে, বা নানারকম কঠিন প্রক্রিয়া করে জেনেছি। এবার এত টাকা দিন, তাহলে যাগ-যজ্ঞ করে সে ছেলে ফিরিয়ে আনব। কিন্তু আপনাকে বাজে কথা বলব না মা, ওসব কিছুই আমি জানি না। আমার একটা জন্মগত ক্ষমতা আছে, আমি স্বপ্নে অনেক কিছু দেখতে পাই। কাল রাত্তিরে এ বাড়িতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে জানলাম আপনার ছোটছেলের কথা
ঠাকুমা বললেন—সে ফিরবে না বাবা?
–না মা। আর কেনই বা ফেরাবেন? তিনি ভাল আছেন, সন্ন্যাস গ্রহণ করে ঈশ্বরের আরাধনা করছেন। জানেন মা, হিন্দুধর্মে বলে কোনো বংশের ছেলে সন্ন্যাসী হয়ে গেলে সেই বংশ পবিত্র হয়ে যায়। আনন্দ করুন মা, ছেলের গৌরবে আনন্দ করুন।
ঠাকুমা অমরের মাথায় হাত দিয়ে বললেন—বাবা, যদি আমার ছোটুকু ভাল থাকে, শান্তি পেয়ে থাকে, তাহলে সে না-ই বা ফিরল। তার সুখেই আমার সুখ। তুমি এটুকু খবর যে দিলে, তার জন্য ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। তুমি আমাকে মা বলে ডাকলে, আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি—
এইসময় অমর হঠাৎ একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। সে বলল—মা, আপনি দেখবেন আপনার ছেলেকে? আমি দেখাতে পারি। কিন্তু কথা দিন, তাকে ফিরে আসবার জন্য আদেশ করবেন না। তাহলে হয়ত সে ফিরে আসবে, তার এতদিনের সাধনা নষ্ট হয়ে যাবে। জগতে মাতৃশক্তি একটা বিরাট শক্তি, কেউ তাকে লঙ্ঘন করতে পারে না। কথা দিন—
বাবা এগিয়ে এসে অমরকে বললেন-দেখ ভাই, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মাকে সরল মানুষ পেয়ে তুমি–
ঠাকুমা বাধা দিয়ে বললেন—তুই থাম। তারপর অমরের দিকে তাকিয়ে। বললেন—আমি কথা দিলাম। আমাকে কী করতে হবে বল–
—কিচ্ছু না। আপনি এইখানে বসুন—
ঠাকুমা তখন নিজে মাটিতে বসতে বা উঠতে পারতেন না। মা আর মেজকাকিমা তাকে ধরে আস্তে করে ঠাকুরদালানের মেঝেতে বসিয়ে দিলেন। সামনে বসল অমর। ঠাকুমার হাত আলতো করে ছুঁয়ে বলল—আমার দিকে তাকান। মন শান্ত করুন, মা। একদম হালকা করে দিন। সোজা আমার চোখের দিকে দেখুন, একদম সোজা
কী বলব ভায়া, তখন ভর সকাল, আমরা অতগুলো লোক দাঁড়িয়ে, আমাদের সামনেই ঠাকুমা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লেন। মাথা হেলে পড়ল না, শরীর কাত হল না, কেবল চোখ দুখানা আস্তে আস্তে বুজে এল। সুন্দর, সমাহিত মুখ—যেন ধ্যান করছেন। অমর একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারও দেহ নিস্পন্দ, সমস্ত শরীরে দৃঢ় একাগ্রতার ভঙ্গি।