বাঙালী বাড়ি ছেড়ে বেরুতে ভালবাসে না। বেশ আছি বাপু কলকাতায়, বাড়ি অবশ্য গ্রামে—তবু ইচ্ছে করলে দুই কী আড়াইঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছতে পারি। শহরে মেসে থাকি, মেস থেকে সকালে স্নান-খাওয়া সেরে পান মুখে দিয়ে ধীরেসুস্থে সাড়ে ন’টায় বেরুলেও কোনও তাড়াহুড়ো না করেই দশটার ভেতর অফিসে হাজির হই। বিকেলে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে অন্য বোর্ডারদের সঙ্গে ব্রিজ খেলায় বসে যাই। রাত দশটায় খাওয়া, এগারোটার মধ্যে বিছানা আশ্রয়। সমস্ত ব্যাপারটার ভেতর একটা নিশ্চিত নির্ভরতা আছে, মসৃণ গতিতে এভাবে জীবন চলে গেলে কে আর যেচে জটিলতা আমদানি। করে? তারপর অফিস থেকে বলছে বটে একমাস, শেষপর্যন্ত সেটা কতদিনে গিয়ে ঠেকবে বলা কঠিন। কাজ শেষ না হলে আমার ভাল লাগছে না বলে বায়না করলে তো আর কোম্পানি কলকাতায় ফিরিয়ে আনবে না। বন্ধু আর আড্ডা ফেলে, সিনেমা থিয়েটার আর শহরের হরেক মজা ফেলে কি জঙ্গলে যেতে ইচ্ছে করে? অফিসের নির্দেশ জানিয়ে বাবাকে চিঠি লিখলাম, আশা ছিল বাবা যদি অত দূরে জনমানবহীন জায়গায় যাওয়া নিয়ে একটুও উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তাহলে বাবার স্বাস্থ্য ভাল নয় এই অজুহাত দেখিয়ে অফিসে দরখাস্ত করে যাওয়া ঠেকাতে চেষ্টা করব। হায় রে! নিজের বাবাকে এতদিনেও কেন ঠিকঠাক চিনিনি তা ভেবে অবাক লাগল। বাবা লিখলেন—স্নেহের বাবাজীবন, তোমার পত্র পাইয়া আনন্দিত হইলাম। কলিকাতার বদ্ধ বাঁচা হইতে এতদিনে কর্মের সূত্রে তোমার বাহিরে যাইবার সুযোগ ঘটিয়াছে ইহার জন্য পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। এক জায়গায় কাদায় গুণ পুঁতিয়া পড়িয়া থাকিলে মনুষ্যত্বের সম্যক বিকাশ ঘটে না। ঈশ্বরের এই সুন্দর সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখিবার সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের কথা। আমাদের যৌবনে এত সুযোগ ছিল না, আমার সারাজীবন পাড়াগ্রামেই কাটিল। যাহা আমি পারি নাই তুমি তাহা করিতে চলিয়াছ ভাবিয়া গর্বিত বোধ করিতেছি। আমার জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করিও না, আমি ভালই আছি। এখনও বেশ পরিশ্রম করিতে পারি। একমাস কেন, ছয়মাস তুমি বাইরে থাকিলেও ক্ষতি হইবে না। নিয়মিত পত্র দিয়া কুশল জানাইবে। ইতি, আশীর্বাদক–বাবা।
নাঃ, বাবাকে আর মানুষ করা গেল না। সুটকেস গোছাতে শুরু করলাম।
হাতে সময় বেশি ছিল না, ভেবেছিলাম যাওয়ার আগে একবার তারানাথের সঙ্গে দেখা করে যাব, কিন্তু তার আর সময় পেলাম না। কিশোরীকে বলে গেলাম সে যেন তারানাথকে জানিয়ে দেয় খবরটা। মেসে একমাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে গেলাম, ম্যানেজারকে জানিয়ে রাখলাম যদি একমাসেরও বেশি দেরি হয় তাহলে মনিঅর্ডারে টাকা পাঠাব, নইলে কিশোরী এসে দিয়ে যাবে। মেসে বহুদিন আছি, ম্যানেজারের সঙ্গে প্রায় বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে, তিনি হেসে বললেন—অ্যাডভান্স না দিলেও চলত। এমনিই চলে যান না, বাইরে যাচ্ছেন, হাতে বাড়তি নগদ থাকা ভাল। আমি অবশ্য শুনলাম না, যেখানে যাচ্ছি সেই জঙ্গলে পয়সা খরচ করার কোনও সুযোগ নেই। খামোক বেশি টাকা হাতে রেখে কী করব?
রাত দশটা বেজে দশ মিনিটে হাওড়া থেকে রাউরকেল্লা এক্সপ্রেস ছাড়ে, সেই ট্রেনে রওনা দিতে হবে। পরদিন ভোররাত্তিরে রাউরকেল্লা নেমে বাস ধরে বিরমিত্রাপুর হয়ে সিমডেগা যেতে হবে। বনজঙ্গল আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে প্রায় ষাট মাইল রাস্তা। সিমডেগা বিহারের রাঁচি জেলায় অবস্থিত হলেও জায়গাটা বিহার উড়িষ্যা আর মধ্যপ্রদেশের প্রায় সংযোগস্থলে। বাঙালী আছে সামান্য কয়েকঘর, বেশিরভাগই বিহারী, মাড়োয়ারি আর হো মুণ্ডা ওরাঁও ইত্যাদি আদিবাসী। সিমডেগায় স্থানীয় অফিস হিসেবে একটা বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে থাকবে আপাতত একজন মালিগোছের কর্মচারী, সে বাড়িঘর দেখাশোনা করবে আর পাহারা দেবে।
বাঙালী বাড়ির বাইরে যেতে চায় না, শুনেছি বেড়াতে যাবার সময় ঘোড়ার গাড়ি ডেকে তাতে মালপত্র তুলে দরজায় তালা বন্ধ করবার সময় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে সে মনে মনে ভাবে না গেলেই হত। আমারও প্রথম দিকে তাই হয়েছিল বটে, কিন্তু যাবার দিন সকাল থেকে মনের বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে বেশ একটা চনমনে ভাব মনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল। সত্যি বলতে কী, একবার পুরী আর একবার বৈদ্যনাথ ধাম ছাড়া সেভাবে বাইরে বেরুনো হয়নি কখনও। মনটা বিভক্ত হয়ে গিয়ে রক্ষণশীল ভাগটা বলছে—ঘরের নিরাপদ পরিবেশ ছেড়ে বেরুচ্ছ কোথায় বাপু? এসব ইচ্ছে তো ভাল নয়। আবার মুক্ত বাতাসলোভী তরুণ সত্তার অংশটা বলছে—বেরিয়ে পড়, এতবড় পৃথিবীটা শত বৈচিত্র্য নিয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে তোমারই জন্য। সে সব না দেখে কলকাতায় কেরানীগিরি করে মরবে!
জিতে গেল তরুণ সত্তা। ইতিহাসে চিরকাল তাই জিতেছে।
রাত্রি দশটার পরে ট্রেন, কাজেই মেস থেকে রাত্তিরের খাওয়া সেরেই বেরুলাম পৌনে দশটার মধ্যে রাউলকেল্লা এক্সপ্রেসের নির্দিষ্ট কামরার সামনে পৌঁছে গেলাম। সার্ভেয়ার সাহেব দেখি আগেই এসে গিয়ে দুখানা বেঞ্চিতে চাদর বিছিয়ে জায়গা অধিকার করে রেখেছেন। ট্রেনে বিশেষ ভিড় নেই, অপর দুটি বেঞ্চির মধ্যে একটিতে মধ্যবয়েসী একজন অবাঙালী ভদ্রলোক পুটলি খুলে সামনে চাপাটির গোছা, সবজি আর আচার নিয়ে বসে গিয়েছেন। অপর বেঞ্চিটি এখনও খালি। সার্ভেয়ার ভদ্রলোকের নাম নির্মল কাঞ্জিলাল, তিনি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নজর রাখছিলেন। আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে বললেন—এই যে, এই কামরায়! চলে আসুন–