দেবদর্শন একটা স্মিত হাসি হেসে বললেন-হা, আজ প্রায় সব রান্নাই অতিথির জন্য বিশেষ করে আমার স্ত্রী বেঁধেছেন—
বললাম—সবচেয়ে ভাল হয়েছিল পোলাওটা। গাওয়া ঘি আর মশলা সব দোকানেই পাওয়া যায়, যে কেউ কিনে আনতে পারে। কিন্তু সবাই কী এমন সুন্দর পোলাও রাঁধতে পারে?
দেবদর্শনের আলবোলা টানার শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
আমার দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে বললেন—পোলাও! কিন্তু আজ দুপুরে তো পোলাও রান্না হয়নি। কী বলছেন আপনি! আমি তো আপনার পাশেই বসে খেলাম–
—আপনি কী খেলেন?
দেবদর্শন বললেন—কেন, সাদা ভাত! চালটা অবশ্য খুবই ভাল ছিল, রামচন্দ্রপুর থেকে আনানো এক নম্বর বাসমতী—কিন্তু তা সে যত ভাল চালই হোক, পোলাও তো কোনোমতেই নয়—
—আপনি কী খেয়েছেন? সাদা ভাত?
—অবশ্যই-কারণ সাদা ভাত ছাড়া কিছু রান্নাই হয়নি।
হেসে বললাম-এবার পুজোর সময়টা ভালই কাটল মুখুজ্জেমশাই, বলুন? শুধু টাকার কথা বলছি না। লটারিতে অর্থাগম প্রতিবছরই কারো না কারো হয়। কিন্তু এবার আপনি গড়ের তোপ শুনলেন, স্বয়ং দেবীকে পায়ের ছাপ ফেলে হেঁটে যেতে দেখলেন। আর আজকের এই পোলাও-এর ব্যাপারটা–
দেবদর্শন মুখ থেকে নল সরিয়ে বললেন—আর অমরজীবনের ব্যাপারটা? তার তো কোন ব্যাখ্যা হল না। কোথা থেকে এসেছিল সে, কোথায়ই বা গেল, কীই-বা তার পরিচয়? আপনি কী কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন ঠাকুরমশাই?
-আন্দাজ করতে হয়তো পেরেছি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।
–কী আন্দাজ করেছেন?
—ঠিক বোঝাতে পারব না মুখুজ্জেমশাই। এই সৃষ্টির রহস্য বড় বিচিত্র, সেই বৈচিত্র্যেরই একটা অংশ অমরজীবন। কেন এই পৃথিবী আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি হয়েছিল, সে কেউ কি জানে? তেমনিই অমরজীবনের পরিচয়—একটা আকস্মিক আবর্তের মত হঠাৎ সে সৃষ্টির ভেতর জেগে উঠেছে, তার কোনো কারণ নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে এটুকু বুঝেছি—তার অস্তিত্ব একটা বড় মাপের শুভশক্তির প্রকাশ
দেবদর্শন বললেন—কী রকম?
বললাম–সৃষ্টির মুহূর্তেই শুভ আর অশুভ দুরকম শক্তি তৈরি হয়েছিল, এ কথার সমর্থন পৃথিবীর সব ধর্মশাস্ত্র আর দর্শনে পাবেন। যেমন আলো আর অন্ধকার, মহত্ত্ব আর নীচতা। এও প্রকৃতির একটা সঠিক আইন, আসল বস্তু না থাকলে পরিপূরক এবং বৈপরীত্যের ধারণা আসবে কী করে? শাসকের অত্যাচার, ধর্মান্ধতা, ধনীদের দম্ভ, নিষ্ঠুরতা—এসবের ভেতর দিয়ে অশুভ শক্তি নিজেকে প্রকট করে। আর উলটো দিকে শুভ আর মহৎ বিশ্বশক্তি নিজেকে স্পষ্ট করে তোলে মহাপুরুষের বাণী, দেশপ্রেমীর আত্মোৎসর্গ, বৈজ্ঞানিকের নিঃস্বার্থ কর্ম—এর মাধ্যমে।
দেবদর্শন বললেন—তার কী প্রয়োজন ছিল? এত জটিল ঝামেলায় না গিয়ে ঈশ্বর তো অবিমিশ্র ভালোও সৃষ্টি করতে পারতেন?
বললাম-এর উত্তর আমি দিতে পারবো না। তবে আমার বিশ্বাস দুনিয়ায় অকারণে কিছুই ঘটে না। কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু আমার সঙ্গে পরামর্শ করে জগৎ সৃষ্টি করেন নি, তাই সব রহস্যের উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যের অতীত। তবে একটা কথা বলি, যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, ঈশ্বরে মতি স্থির রাখবেন। যে যাই বলুন, তিনি আছেনই।
পরের দিন সকালবেলা জলখাবার খাওয়ার পর বেরিয়ে পড়লাম। গ্রামের প্রান্ত অবধি এগিয়ে দিতে এলেন দেবদর্শন। আমি বারণ করেছিলাম, তিনি শুনলেন না। গ্রামের একেবারে শেষ সীমায়, একটা মহানিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাকে বললাম—আর নয়, এবার ফিরে যান। আবার দেখা হবে–
ব্যগ্রভাবে আমার হাতদুটো ধরে দেবদর্শন বললেন–দেখা হবে বলছেন?
একটু ইতস্তত করে বললাম দেখা হবে। আর যদি কোন কারণে আমাকে খুব প্রয়োজন হয় তাহলে–
—কী তাহলে?
—তাহলে নির্জনে কোথাও দাঁড়িয়ে মধুসুন্দরী দেবীর নাম উচ্চারণ করে একান্তভাবে আমার দেখা পেতে চাইবেন। যেখানেই থাকি না কেন, আমি ঠিক জানতে পারব।
—ব্যস, এতেই হবে? মধুসুন্দরী দেবী কে?
বললাম—এতেই হবে। মধুসুন্দরী দেবী আমার আরাধ্যা। কী করে আপনার ডাক শুনতে পাবো আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না, কারণ আমিও তার উত্তর জানি না।
আর পেছনে না তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
গল্প থামিয়ে তারানাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল—আজ এই পর্যন্ত থাক। সামনে যেদিন আসবে সেদিন আবার কিছুটা বলা যাবে।
কিশোরী বলল—গল্প শুনতে তো খুবই ভাল লাগে। কিন্তু চট করে ফুরিয়ে যাবে না তো?
তারানাথ হেসে বলল-ফুরিয়ে যাবে কী হে! এই তো সবে পানিফলের ঝকে টান দিয়েছি। পুরো ঝাক এক জায়গায় হতে এখনো দেরি আছে। আচ্ছা, সামনের দিন বলা যাবে বাকিটা।
১২. তারানাথের কাছ থেকে চলে আসার ঠিক পরে
সেদিন তারানাথের কাছ থেকে চলে আসার ঠিক পরে পরেই কোনও ছুটির দিন ছিল না। তারপর দুটো রবিবার আমি আর কিশোরী দুজনেই ব্যস্ত ছিলাম, ফলে গল্পের দারুণ আকর্ষণ থাকলেও তারানাথের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আমরা ইচ্ছে করেও মাঝে মাঝে ফাঁক দিই, বিশেষ করে একটু পুরনো আর লম্বা গল্প শোনার সময়। এ ধরনের গল্প একদিন বা দুদিনে শেষ হয় না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ডুব দিয়ে আমরা দেখতে চাই তারানাথ গল্পের খুঁটিনাটিতে কোনও গোলমাল করে ফেলে কিনা। আজ পর্যন্ত তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি, তিনমাস পরে ফের শুরু করলেও সব সে ঠিকঠাক বলে। নামধাম ভুল করে না, তারিখ গুলিয়ে ফেলে না, কে কার কী হয় তা সঠিক মনে। রাখে। ফলে আমরা তার গল্প এখন প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আগের মত কেবল গল্পের নেশা নয়, তার সঙ্গে মিশেছে বেশ কিছুটা শ্রদ্ধা। তবে এবার গল্পের খেই ধরতে একটু দেরি হল, কারণ যে কোম্পানিতে আমি কাজ করি তারা হঠাৎ মাসখানেকের জন্য আমাকে বদলি করল বিহার আর মধ্যপ্রদেশের সীমান্তে একটা জায়গায়। সেখানে কোম্পানির নতুন কারখানা হবে, দু-তিনটে জায়গা দেখা হয়েছে। আপাতত অফিসের একজন মেজকর্তা, সার্ভেয়ার আর আমি যাচ্ছি। ঘোর পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু ফেলে থাকতে হবে। রান্নাবান্না, জঙ্গল পরিষ্কার করা, জরিপের কাজে সাহায্য—এসবের জন্য জনপনেরো লোক স্থানীয় কোনও আদিবাসী গ্রাম থেকে জোগাড় করতে হবে। আমার কাজ হল তহবিল আর হিসেবপত্র রাখা, আর সাধারণভাবে সবকিছুর তত্ত্বাবধান করা।