আমি চুপ করতে দেবদর্শন বললেন—কে তিনি? বলুন ঠাকুরমশাই–
—তিনি স্বয়ং দেবী। আপনি আজ দেবীর আশীর্বাদ পেয়েছেন।
দেবদর্শন বললেন—এখান দিয়ে তিনি হেঁটে গিয়েছেন। এই তাঁর পদচিহ্ন! আমার স্ত্রীর রূপে তিনি দেখা দিলেন কেন? তবে, তবে কি–
এর আর কী উত্তর দেব? বললাম—মায়েরা সকলেই দেবী।
হাতের হালকা ছোঁয়ায় দেবদর্শন মন্দিরের দরজা খুললেন।
মাটির পিলসুজের ওপর মাটির তৈরি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে মন্দিরের ভেতর। অন্যদিন ছছাটমাপের রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলে, সেটিও পাশেই রাখা আছে। সন্ধ্যেবেলা নিত্যপূজার পর জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। এখনো তা জ্বলছে। সেই স্নিগ্ধ আলোয় দেবীর প্রস্তরময়ী প্রতিমা যেন মুখে সত্যিকারের হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। এবং–
এবং দেবীর মূর্তির ডানহাতে একটি উঁটিওয়ালা তাজা পদ্ম।
এরপরে আর কোন প্রশ্ন থাকে না। আমি এবং দেবদর্শন করজোড়ে দেবীকে প্রণাম জানালাম।
দু’হাতে কড়া ধরে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিলেন দেবদর্শন। তারপর পেছন ফিরেই বললেন—এ কি!
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মন্দিরের চাতালের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাদা সেই পদচিহ্ন আর নেই। শুধু চাতালেই নয়, সিঁড়ির ধাপে ধাপে এবং সঁড়িপথে শ্বেতসঙ্কেতে আঁকা সেই দেবীর পায়ের ছাপ আর কোথাও নেই। দেবী আমাকে এবং গৃহস্বামীকে জানিয়ে দিতে এসেছিলেন যে, তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল।
না ঘুমিয়েই রাত শেষ হয়ে গেল। সকালে নদী থেকে স্নান করে এসে বৈঠকখানায় বসলাম। একটু পরে দেবদর্শনও ভেতরবাড়ি থেকে এসে বসলেন। তারও স্নান হয়ে গিয়েছে। রঘু এসে তামাক দিয়ে গেল। দেবদর্শনের মুখেচোখে দিব্যানুভূতির উদ্ভাস, ইনি যেন আর ঠিক কালকের সেই মানুষ নন। আজ যেন তিনি অনেক বেশি সৌম্য, অনেক বেশি গভীর।
বললাম-এবার যে আমাকে যেতে হবে মুখুজ্জেমশাই। অনেকদিন হয়ে গেল, আবার। পথ ডাকছে–
দেবদর্শন চমকে উঠে বললেন—সে কী! চলে যাবেন। কেন?
হেসে বললাম—পরিব্রাজকের এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে নেই, তাতে আসক্তি জন্মায়। এই যে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়, বন্ধুত্ব—এই পর্যন্তই ভাল। এর চেয়ে বেশি গভীরতা হলে তা বন্ধন হয়ে পায়ে জড়িয়ে যাবে।
দেবদর্শন চুপ করে তামাক খেতে লাগলেন।
বললাম—কথাগুলো একটু নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে, না?
দেবদর্শন কিছু বললেন না।
-রাগ করবেন না। জীবনে কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা রূঢ় হলেও সত্য। এক জায়গায় থেকে জীবন কাটাবো এমন ইচ্ছে থাকলে তো বাড়িতেই থাকতাম, মাকে কাঁদিয়ে গৃহত্যাগ করতাম না। ভালবাসা, বন্ধুত্ব, প্রীতির সম্পর্ক—এসব খুব ভাল জিনিস, কিন্তু যে মোহ আবরণ মহত্তর সত্য থেকে আমাদের আড়াল করে রেখেছে তার থেকে মুক্তি পেতে হলে যতই কষ্ট হোক পথে বেরিয়ে পড়তে হবে। আমি আপনাদের ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ছি। এবার যেতে হবে–
দেবদর্শন তামাক খেয়ে যেতে লাগলেন।
খোলা দরজা দিয়ে সকালের আলোয় উজ্জ্বল আমবাগান-বাঁশবাগান দেখতে পাচ্ছি। সঁড়িপথটা দিয়ে জাল কঁাধে গান গাইতে গাইতে একজন জেলে এবং তার পরে-পরেই একজন রাখাল কয়েকটা গরু নিয়ে মাঠের দিকে গেল। আজকালকার ছেলেদের ইস্কুলের পড়ার বইতে যেমন পাড়াগাঁর বর্ণনার সঙ্গে কবিতা থাকে—রাখাল গরুর পাল লয়ে যায়। মাঠে’—ঠিক তেমনি। আজকাল ছাত্রদের ছবি এঁকে আর কবিতা লিখে বোঝাতে হয় গ্রাম কেমন ছিল, বাঁশঝাড় কাকে বলে না, হেসো নাসত্যিই তাই। কলকাতা শহরে মোটরগাড়ি চেপে মানুষ হয়েছে এমন বড়লোকের ছেলেপুলেরা কেউই গ্রাম দেখেনি। মজার কথা কী জানো, এদের অনেকেরই আদি বাড়ি কিন্তু গ্রামে। এক বা দুই পুরুষ আগে এদের বংশের কেউ একজন হয়তো বেশি উপার্জনের লোভে বা অন্য কোন সুবিধের জন্য গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছিল শহরে বাস করতে। তার দেখাদেখি আরো অনেকে। এদের গ্রামের প্রাচীন ভদ্রাসন ভেঙে পড়ছে, কার্নিসে বট-অশ্বথের চারা আর উঠোনে আগাছা জন্মাচ্ছে, কবজা থেকে দরজা ভেঙে ঝুলছে—কিন্তু দরজার কড়ায় তালা এখন আটকানো। এসব বংশের ছেলেপুলেরা এখন বড়বড় চাকরি করে, কেউ বালিগঞ্জে কেউ ভবানীপুরে বাড়ি করেছে। মজা ডোবা আর ম্যালেরিয়ায় ভরা গ্রামে তারা আর কেউ বাস করতে ফিরে যাবে না।
কিশোরী বলল—আমি কিন্তু একটি পরিবারকে জানি যারা প্রতিবছর নিয়ম করে অন্তত একবার গ্রামের বাড়ি যায়—
তারানাথ হেসে বলল—ওরকম দু’একটা উদাহরণ দিলে তো সত্য বদলাবে না। আমিও জানি কেউ কেউ আছে যারা সাধারণত দুর্গাপুজোর আগে গ্রামের বাড়িতে বছরে একবার করে ফিরে যায়, তোক লাগিয়ে আগাছা বা বনজঙ্গল পরিষ্কার করায়। সম্ভব হলে একবার হালকা চুনকাম করায়। তারপর ধূমধামে দুর্গাপুজো করে দেওয়ালির পর আবার কলকাতায় ফিরে আসে।
এবার আমি বললাম-সে তো ভালো কথাই, এতে নিন্দের কী আছে? বছরে অন্তত একবার হলেও তো তারা দেশের বাড়ির টানে ফিরে আসে।
তারানাথ বলল—জিনিসটা অত হালকাভাবে দেখো না। এরা সবাই যে জন্মভূমির টানে ফিরে যায় এমন নয়। কেউ কেউ গরিব গ্রামবাসী আর শরিকদের কাছে নিজের ঐশ্বর্য আর বৈভব দেখাতে যায়।
একটু থেমে একটা পাসিং শো ধরালো তারানাথ। মৃদুমন্দ টান দিয়ে সিগারেটের একচতুর্থাংশ শেষ কবে নারকেলের মালায়, ছাই ঝেড়ে সে বলল—আগে মানুষ অনেক বেশি ধর্মভীরু ছিল। শত দুঃখকষ্টেও ভদ্রাসন ছেড়ে যেতে চাইতো না। এখন আর ওসব। আবেগকে কেউ প্রশ্রয় দেয় না। উপার্জনের লোভে কোথাকার মানুষ কোথায় চলে যাচ্ছে কারো কোনো শেকড় নেই। সমাজ দিনে দিনে শিথিল হয়ে পড়ছে।