ফেরবার সময় আমাদের ডানদিকে বাঁশঝাড়ের পাশে বিশালাক্ষী মন্দিরটা পড়লো, তার ওধারে মুখুজ্জেবাড়ি। আর বাঁদিকে পথ থেকে একটু ভেতরে পুজোমণ্ডপ। পুজোর জায়গায় ঢোকবার মুখে দেবদর্শন থমকে দাঁড়িয়ে নিজের বাড়ি থেকে আসার পথের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক গলায় বললেন—এ কী! এদের আজ হল কী! বারবার কোথায় যাওয়া-আসা করছে?
তাকিয়ে দেখলাম মুখুজ্জেগিন্নী বাড়ির অন্য মেয়ে-বৌদের সঙ্গে চলেছেন পুজোমণ্ডপে। মানে তিনি বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন, এখন আবার সবাইকে নিয়ে পুজো দেখতে যাচ্ছেন।
পুজো শেষ হয়ে গেল, পুরোহিত শান্তিজল আর চরণামৃত দিলেন সবাইকে। ওদিকে কয়েকজন কর্মচারী প্রসাদ বিতরণ শুরু করেছে। ছোট ছোট চেরা কলাপাতার টুকরোয় বাতাসা আখের টিকলি শসা পানিফল বাতাবিলেবু আর ভেজা আতপচাল কলা দিয়ে চটকে মাখা। খিচুড়ি-ভোগ একটু বেশি রাত্তিরে শুরু হবে। বাচ্চারা সামিয়ানার নিচে ছোটাছুটি করছে, বয়স্করা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে ব্যস্ত। আমরাও বৈঠকখানায় ফিরে এলাম। কোনও কারণে দেবদর্শনের দ্ৰ কুঁচকে রয়েছে, কিছু একটা ভাবছেন ভদ্রলোক।
রঘু তামাক দিয়ে গেল। তামাক টানতে টানতে এটা-সেটা গল্প করছি, কিন্তু দেবদর্শনের মুখের গম্ভীর ভাবটা যাচ্ছে না। হঠাৎ উনি বললেন—ঠাকুরমশাই, আমার স্ত্রী যখন প্রথমবার এক বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করতে যাচ্ছিলেন, তখন তার হাতে কিছু ছিল কি?
অকস্মাৎ এই প্রশ্নে একটু অবাক হয়ে বললাম—হাতে? আমি তো ঠিক—দাঁড়ান, একখানা উঁটাওয়ালা পদ্ম ছিল বোধহয়, তাই না?
দেবদর্শন বললেন—আর দ্বিতীয়বার?
—যখন বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আসছিলেন?
—হ্যাঁ।
—তখন তো হাতে পুজোর ডালা ছিল। কেন, এ প্রশ্ন করছেন কেন?
দেবদর্শন যেন কিছুটা আপনমনেই বললেন—তাহলে পদ্মটা উনি কোথায় রেখে এলেন? পরে তো হাতে ছিল না—
এই সামান্য ব্যাপারে দেবদর্শন ব্যস্ত হচ্ছেন কেন বুঝতে পারলাম না। বললাম—ডালাতেই রাখা ছিল হয়ত, পাশ থেকে দেখা যায়নি–
-তাই? তা হবে হয়ত, অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। নইলে আর যাবে কোথায়?
মানুষের একটা না একটা বাতিক থাকেই, ভেবে মজা লাগল। দেবদর্শনের মত বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান লোক এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এতক্ষণ মাথা ঘামাচ্ছেন!
নিমন্ত্রিতদের খাওয়া মিটতে মিটতে অনেক রাত্তির হয়ে গেল। এ পরিবারের নিয়ম, বাইরের কারও খাওয়া বাকি থাকতে বাড়ির কেউ খেতে বসবেন না। আমরা বৈঠকখানাতে বসেই তামাক খাচ্ছিলাম, রাত একটা কী দেড়টা নাগাদ রঘু এসে দেবদর্শনকে বলল—চলুন কর্তামশাই, খাবার জায়গা হয়েছে—
ভেতরবাড়ির বারান্দায় খেতে বসলাম দুজনে। কলাপাতায় করে খাওয়া, মুখুজ্জেবাড়ির রীতি অনুযায়ী পুজোর প্রসাদ ধাতুপাত্রে পরিবেশন করা হয় না। খিচুড়ি, পাঁচভাজা, পাঁচমিশেলি একটা ঘণ্ট—তার মধ্যে আলু কচু বেগুন থােড় পালংপাতা চালকুমড়ো সবই আছে, তারপর লুচি আর পায়েস। একটা জিনিস বরাবর দেখেছি, পুজোর ভোগ হিসেবে যে খিচুড়ি রান্না হয় তার স্বাদ অদ্ভুতভাবে আলাদা। বর্ষার দিনে গরম খিচুড়ি আর ডিমভাজা খাবার ইচ্ছে হয়েছে? বেশ তো, বেঁধে খাও। চড়ইভাতি কিম্বা পোষলায় খিচুড়ি রান্না হয়েছে? বেশ তো, পেট ভরে খাও। রান্না নিশ্চয় ভাল হবে, কিন্তু সে অন্যরকমের ভাল, পুজোর ভোগের স্বাদ তাতে পাবে না।
কিশোরী বলল—তার কারণ আমাদের মনের ধর্মভাব। বৃষ্টির দিনে বা পৌষলায় রান্না করা হয় মনে একটা আড্ডা বা হুল্লোড়ের ভাব নিয়ে, আর পুজোর ভোগ রাঁধবার সময় মনে পবিত্র ধর্মীয় সচেতনতা জেগে থাকে—তাই পার্থক্য। নইলে একই চাল-ডালমশলায় তৈরি খাবারে অন্যরকম স্বাদ হবে কেন?
তারানাথ বলল—তাই হবে হয়ত। যাক, গল্পটা শোন।
মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছি, বুঝতে পারছি রান্নাঘরের দরজার পাশে মুখুজ্জেগিন্নী দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অতিথির খাওয়ার সময় গৃহকত্রীর উপস্থিত থাকা বনেদি বাড়ির নিয়ম। হয়ত তিনি কথা বলবেন না, কোন ছোট মেয়ে বা কর্মচারীর মাধ্যমে কী লাগবে তা জিজ্ঞাসা করে নেবেন, কিন্তু নিজে আড়ালে দাঁড়িয়ে সমস্ত সময়টা তদারক করবেন। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য পরিস্থিতি একটু অন্যরকম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরপর দুবার কিছুদিনের ভেতর এসে অতিথি হওয়ায়, মুখুজ্জেগিন্নীর সহজ মাতৃত্বপূর্ণ চরিত্রের জন্য, আর লটারির প্রাইজ পাবার টিকিটটা যে আমিই বেছে দিয়েছি সে খবরটা রাষ্ট্র হয়ে পড়ায় বাড়ির সকলেই আমাকে একান্ত আপনজন বলে ভাবতে শুরু করেছে।
খেতে খেতে দেবদর্শন বললেন—বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করে আবার ফিরে গিয়েছিলে কেন? সবাইকে নিয়ে একবারেই তো গেলে পারতে–
দরজার আড়ালে একটুখানি বিস্মিত নীরবতা। তারপর মুখুজ্জেগিন্নী একটু অবাক গলায় বললেন—বিশালাক্ষী মন্দিরে? সেখানে আমি যাইনি তো!
খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে তাকালেন দেবদর্শন।
–যাওনি! কী বলছ তুমি!
—ঠিকই বলছি। বাড়ির মেয়েরা মিলে যখন পুজোর জায়গায় যাচ্ছি তখন তো তোমার সঙ্গে দেখাই হল, তুমি আর ঠাকুরমশাই মিলে নদীর ধারের পথ দিয়ে ফিরছিলে। আমাদের দেখে বাঁশঝাড়ের তলায় দাঁড়িয়ে ওঁকে কী যেন বললে। তার আগে আবার কোথায় গেলাম?
—তার একটু আগে তুমি একা যাওনি বিশালাক্ষী মন্দিরে প্রণাম করতে?
-না তো! আমি, রাজুর মা, বিরাজপিসি আর ছেলেপুলেরা মিলে একবারই বেরিয়েছিলাম। কেন জিজ্ঞাসা করছ বল তো? কিছু হয়েছে নাকি?