তারানাথ বলল—না। অমরজীবনের কাহিনী এখনও চলছে।
একটু বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালাম। তারানাথ ও-প্রসঙ্গে আর কিছু বলল না বটে, কিন্তু কেমন করে যেন স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সে কী বলতে চায়। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে বোধ করি অমরজীবনের গল্পটা মিশে রয়েছে, হঠাৎ কোথাও তো তা শেষ হবার নয়।
বললাম—এ গল্পের তাহলে এখনও অনেক বাকি?
—অনেক। আজকে তো শেষ হবেই না, যতদিন বাঁচব একটু একটু করে বলে গেলেও শেষ হবে না। তা সে যাই হোক, আপাতত দেবদর্শন মুখুজ্জের অংশটুকু বলে শেষ করি। তারপর আবার আর একদিন হবে। তোমরা পানিফল তো খেয়েছ নিশ্চয়, পুকুরে পানিফলের ঝাক দেখেছ কখনও?
হঠাৎ হঠাৎ তারানাথ এরকম কথার গতি পরিবর্তন করে থাকে। হেসে বললামদেখেছি। আমারও তো গ্রামেই বাড়ি। কেন?
–পানিফলের ঝক অর্ধেক পুকুর ছেয়ে থাকে, কিন্তু যে কোন একটা জায়গা ধরে টান দিলে সবটা একসঙ্গে নড়ে ওঠে। আমাদের বেঁচে থাকাও ঠিক তাই। আলাদা ঘটনা বলে কিছু হয় না। সবকিছু সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি তুমি দেবদর্শন অমরজীবন জীবন মৃত্যু হাসি কান্না—সব। তোমাদের এখনও বয়েস অল্প, পরে নিজেরাই সব বুঝবে।
ছাইদানি হিসেবে ব্যবহৃত নারকেলের মালায় সিগারেটের দগ্ধাবশিষ্টটুকু গুঁজে দিয়ে তারানাথ শুরু করল।
–পূর্ণিমার আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। তেমন জ্যোৎস্না তোমরা শহরে কখনও দেখবে না। পাখিরা সকাল হয়ে গিয়েছে মনে করে ডাকতে আরম্ভ করে। ঈষৎ শীত-শীত। ভাব পরিবেশে, অথচ পুরো ঠাণ্ডা পড়েনি। এখানে ওখানে কাশের গুচ্ছ চাঁদের আলোয় দেখাচ্ছে যেন রূপোর মেঘ। পুজোমণ্ডপে বড্ড ভিড়, তাছাড়া আজ দেবদর্শনের প্রাইজ পাওয়ার ব্যাপারটা সর্বত্র উত্তেজনা তৈরি করেছে। ভূষণ রায় আর আমাকে দেখলেই লোকে কথা বলবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ছে। তার চেয়ে ভিড় থেকে দূরে আপনমনে থাকাই ভাল।
মুখুজ্জেবাড়ির বাঁদিকে নদীতে যাবার পথের মুখে একটা পুরনো ভাঙা মন্দির। জ্যোৎস্নায় দেখাচ্ছে যেন হালকা জলরঙে আঁকা ছবি। সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মাথার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে ডানা মেলে একটা বেশ বড় সাদা লক্ষ্মীপ্যাচা উড়ে গিয়ে মন্দিরের চূড়ায় বসল। মন্দিরটা মুখুজ্জে-পরিবারের পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে আর্থিক কারণে কিছুটা ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হলেও একজন পুরোহিত সেখানে নিত্যপূজা করে আসেন, সন্ধেবেলা আরতি হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠিতা দেবী বিশালাক্ষী। কালো পাথরের মূর্তি, ভারি প্রশান্ত মুখ। ঠিক আজকের দিনেই বংশের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মন্দিরের ওপর লক্ষ্মীপ্যাঁচার উড়ে বসাটা একটা সুলক্ষণ।
মৃদু পায়ের আওয়াজ শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি কখন দেবদর্শন এসে দাঁড়িয়েছেন, হাতজোড় করে প্রণাম করছেন মন্দিরের দিকে মুখ করে। তাঁর মুখ উদ্ভাসিত।
বললাম-প্রণামটা কি প্যাচাকে?।
দেবদর্শন হেসে বললেন—না, দেবীকে। তবে ঈশ্বরের প্রকাশ সর্বজীবেই, প্যাচাকে প্রণাম করলে অন্যায় কী?
–অন্যায় আর কী! যে স্তরে উঠলে ওই উপলব্ধি হয়, সেখানে পেঁছলে সবাই সমান। আর পাচা প্রাণীটিও বেশ সুন্দর।
দেবদর্শন কেবলমাত্র উঁদে বৈষয়িক জমিদার নন সেকথা তো আগেই বলেছি। মানুষটার ভেতর কবিত্ব আর সৌন্দর্য মিশে গিয়ে চমৎকার একটি স্নিগ্ধ রসায়ন তৈরি করেছে। তিনি বললেন—পুজোমণ্ডপে বেজায় ভিড় জমেছে। আপনাকেও দেখতে পেলাম না। ঠিক। বুঝেছি আপনি এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। তাই আমিও চলে এলাম। কী অপূর্ব জ্যোৎস্না ফুটেছে দেখছেন! এই দেখ, ইনি আবার একা চললেন কোথায়?
জমিদারবাড়ি থেকে বেরিয়ে এক ঘোমটা দেওয়া বৌ মানুষ পায়ে চলা সঁড়ি পথটা দিয়ে বিশালাক্ষী মন্দিরের দিকে চলেছেন। বোধহয় মুখুজ্জেগিন্নী, মন্দিরে প্রণাম করে তারপর পুজোর জায়গায় যাবেন। বললাম—বৌঠান না?
দেবদর্শন বললেন—হ্যাঁ। কিন্তু একা যাচ্ছেন কেন? বাড়ির বাকি মেয়েরা কই? পেছনে সব আসছে বোধহয়—
দেবদর্শনের স্ত্রী কিন্তু মন্দিরের পৈঠায় বা চালাতে দাঁড়িয়ে প্রণাম সারলেন না, সিঁড়ি বেয়ে উঠে মন্দিরে ঢুকে গেলেন। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বেরুবার সময় উনি আমাদের দেখতে পাবেন, ওঁর অস্বস্তি হতে পারে সেকথা ভেবে আমি বললাম—চলুন মুখুজ্জেমশাই, নদীর দিক থেকে একটু ঘুরে আসি
আবার বলছি, সে-সব দিনের কথা ভাবলে এখনও বুকের মধ্যেটা কেমন করে ওঠে। জ্যোৎস্না এত সাদা ধপধপে যে, নদীর ধারের সাদা বালির চরে দাঁড়িয়ে সময়টা দিনের বেলা বলে ভুল হয়। খুব হাল্কা বাতাসে চরে গজিয়ে ওঠা কাশগুচ্ছ দুলছে, কট কটু করে ডাকছে কী একটা নিশাচর পোকা। বয়েস অল্প, পৃথিবী বিশাল, শরীর নীরোগ, প্রকৃতি সুন্দর, ঈশ্বর তার সিংহাসনে আসীন—এবং দুনিয়ার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। তখন অমর ছিলাম, পৃথিবীতে কোনও গ্লানি ছিল না, কালো রঙ ছিল না, বুকভরা অকারণ আনন্দ ছিল, মৃত্যু ছিল আবছা জনশ্রুতি। সে বাংলাও আর নেই—আমার এই কথাকে জীবনের পেছনদিকে ফিরে তাকিয়ে প্রৌঢ়ের স্বাভাবিক হাহাকার মনে কোরো না—তখন দিনকাল সত্যিই অন্যরকম ছিল। মনের ভেতরের সেই আনন্দ মিশিয়ে শরৎরাত্রি অপরূপ হয়ে উঠত।
যুগ যুগ ধরে শারদ পূর্ণিমার রাত্রির সঙ্গে উৎসবের একটা সম্পর্ক আছে বলেই কিনা জানি না, এই রাত্তিরটার একটা মায়াময় রূপ আছে। দেবদর্শনের বড় গুণ, তিনি অকারণে কথা বলে পরিবেশের গাম্ভীর্য নষ্ট করেন না। কাশফুলে ঢাকা জ্যোৎস্নামাখা সাদা বালির চরে দুজনে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম, কিন্তু দেবদর্শন কথা বলে পরিবেশের মাধুর্য নষ্ট করলেন না। কিছুক্ষণ পরে আমিই বললাম—চলুন, এবার ফিরে যাই। পুজো এতক্ষণ শেষ হয়ে এলো।