খারাপ সময় যে যাচ্ছে তাতে আর সন্দেহ কী? প্রথম যেদিন আমরা আলাপ করতে এসেছিলাম, সেদিন আমাদের পাওনাদার ভেবে তারানাথ প্রথমে বাইরে আসেনি। তার ছেলে এসে আমাদের কী প্রয়োজন জেনে ভেতরে গিয়ে খবর দিতে তারপর তারানাথ। বেরিয়েছিল। মানুষ হিসেবে তার চরিত্র আদর্শ বা প্রশংসনীয় হয়ত নয়, কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের একটা আশ্চর্য আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। তার গল্প বিশ্বাস হোক বা না-ই হোক, শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠে আসার উপায় থাকে না।
তারানাথ আবার বলতে শুরু করল।
উজ্জ্বলমুখে বাড়ির ভেতর থেকে ফিরে এলেন দেবদর্শন। বললাম-কী, কেমন লাগছে?
মানুষটি অত্যন্ত সংযমী! যে খবর তিনি একটু আগে শুনেছেন অন্য কেউ সে সংবাদ পেলে কী যে করত তার ঠিক নেই। কিন্তু দেবদর্শন বাইরে কোনও উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে সবাইকে বললেন–যাও, তোমরা পুজোর জায়গায় যাও। আমি আসছি—
তাপোষের একপাশে বসে তাকিয়ায় কনুই রেখে হেলান দিয়ে দেবদর্শন, তারপর বললেন—ঠাকুরমশাই, টাকাটা তাহলে পাইয়েই দিলেন?
হেসে বললাম—আমি কেন? টিকিট বিক্রি করেছে ভূষণ রায়, কিনেছেন আপনি। ঘোড়া দৌড়েছে বিলেতে, খবর এসেছে ডাকবিভাগের টেলিগ্রামে—আমি কী করলাম?
দেবদর্শন মিষ্টি করে হাসলেন। তার ব্যক্তিত্বের স্বরূপটাই মিষ্টি।
—ওসব কথা থাক, আপনি কী করেছেন আমি তা জানি। কেবল কয়েকটা জিনিস ঠিক বুঝতে পারছি না–
—যেমন? কী জিনিস?
—আবছা আবছা বুঝতে পারছি অমরজীবনের ছড়ার সঙ্গে টিকিটের নম্বরের একটা কিছু যোগ আছে। নইলে ভূষণ রায়ের পছন্দ করে দেওয়া টিকিট আপনি বদলাতে বলবেন কেন? ছড়াটার মানেই বা কী?
বললাম—মুখুজ্যেমশাই, অমরজীবন ছড়ার মধ্যে যে সংকেত ব্যবহার করেছিল সেটা একটা পুরনো ধাঁধা। আমাদের ছোটবেলায় দেশে ঘরে খুব প্রচলিত ছিল। নানারকম চেহারায় এই ধাঁধা বাসরঘরে কিংবা বাড়িতে জামাই এলে তাকে ঠকানোর জন্য ফিরে ফিরে দেখা দিতো। ছোটবেলায় ধারাপাত পড়েছেন তো? ধারাপাতের প্রথম দিকে একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ’ কবিতাটা মনে পড়ছে কি? অমরজীবনের ছড়ার মূল সংকেতও ওই ধারাপাতের কবিতা।
দেবদর্শন বললেন—ঠিক বুঝতে পারছি না ঠাকুরমশাই। আর একটু খুলে বলবেন?
বললাম—কবিতাটা মনে করুন। দিকে দিকে সাগরেতে ভাই, চোখে চোখে চাদ খুঁজে পাই। দিক কখানা? চারটে তো? পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ। তাহলে দুবার ‘দিক’—অর্থাৎ ৪-৪, ঠিক আছে? পরের কথা সাগরেতে। সাগর কটা? না, সপ্তসমুদ্র। তাহলে এ পর্যন্ত কী হল? দিক, দিক, সাগর—৪-৪-৭। পরের লাইনে ছড়ায় বলেছে—চোখে চোখে চাদ খুঁজে পাই। তিনে নেত্র, অর্থাৎ পরপর দুটো তিন হবে। আর চাদ তো একটা। কাজেই পুরো সংখ্যাটা দাঁড়ালো ৪ ৪ ৭ ৩ ৩ ১। আপনি এর চারখানা আগের নম্বরের টিকিট নিচ্ছিলেন। নিলে একটুর জন্য প্রাইজটা হাতছাড়া হয়ে যেত। আমি কেউ না, মুখুজ্যে মশাই। পুরস্কারটা আপনার ভাগ্যই পাইয়ে দিয়েছে—অমরজীবনের মাধ্যমে।
কিছুক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন দেবদর্শন। তারপর বললেন—অমরজীবন কে?
বললাম-আমি জানি না মুখুজ্যেমশাই। এ প্রশ্ন আপনি আগেও করেছেন, উত্তর জানা থাকলে আমারও আনন্দ হতো। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই থাক না। তাতে জীবন সরস থাকে, জীবনে বিশ্বাস থাকে, আনন্দ থাকে। সব জেনে ফেলতে নেই। চলুন, পুজোর সময় হলো, আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে–
দেবদর্শনকে পুজোমণ্ডপে আসতে দেখে সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠে দাঁড়াল। সেদিনকার পুজোর পরিবেশই আলাদা। অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া কোনও অলৌকিক ঘটনা, অন্তত আমরা সঠিক ব্যাখ্যার অভাবে যাকে অলৌকিক বলে মনে করি, তা মানুষের মনে বিশ্বাস আর ভক্তির জোয়ার এনে দেয়। সেদিনও তাই হয়েছিল–
বললাম—তাতে আর অন্যায় কী? রোজকার জীবনে যা ঘটে না, তেমন অদ্ভুত কিছু চোখের সামনে ঘটতে দেখলে মানুষ তো আপ্লুত হবেই, তাই না? এ একটা পাসিং শো ধরিয়ে তারানাথ বলল—সাধারণভাবে কথাটা ঠিক, কিন্তু ওই বিশ্বাস আর আবেগের প্রকৃত কোনও মূল্য নেই–
কিশোরী বলল—কেন, একথা বলছেন কেন? হয়ত আশ্চর্য বা অলৌকিক কিছু দেখে। বিশ্বাস বা ভক্তির ভাব জেগে উঠেছে, কিন্তু তাতে ওই বিশ্বাস কি মিথ্যে হয়ে যাবে? এ যুক্তি আমার ঠিক বলে মনে হচ্ছে না—
যা তারানাথ বলল—মিথ্যে হয়ে যাবে এমন কথা বলছি না, কিন্তু সরল বিশ্বাসের মূল্য। তার সারল্যেই। কিছু পাব বলে আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে ভাল লাগে বলেই তা করি। যদি কেউ অন্যরকম করে, তবে তা দোকানদারি। বাবার সম্পত্তি পাব, তাই বাবাকে ভালবাসি—এ কেমন কথা?
কিশোরী বলল—সে আশা কি মনের কোণে একটু থাকে না?
–থাকলে সে কেমন ভালবাসা তুমিই ভেবে দেখ। জানি, যে কোনও ভালবাসাই শেষ পর্যন্ত স্বার্থের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকে—মাও যে শিশুকে ভালবাসেন, তা ওই ভালবাসার পরিবর্তে বাৎসল্যের রসঘন তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি হয় বলেই। তবু নিছক বৈষয়িক স্বার্থের চেয়ে কি তা ভাল নয়? কোন না কোন আসক্তি যদি জীবনে থাকতেই হয়, তাহলে ঈশ্বরে নিষ্কাম আসক্তি থাকুক–
আলোচনার গতি দেখে ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম। কিশোরীটা চিরকালের বুদ্ধিহীন কুতার্কিক, বেশ জমাট গল্পের স্রোত বয়ে চলেছে, হঠাৎ এর মধ্যে নৈয়ায়িক আচার্যের সদসৎ বিচার না আনলেই কি চলত না? এখন তর্ক জমে উঠলেই গল্প ডুবে যাবে। বললাম—সে তো ঠিকই, খুব ন্যায্য কথা। যাই হোক, অমরজীবন-রহস্য কি শেষ পর্যন্ত ভেদ হয়েছিল?