তারানাথ সিগারেট ধরাবার জন্য থামল। জিজ্ঞাসা করলাম—নীল গণেশ দিয়ে কী হয়?
—নীল গণেশ খুব শুভকারী দেবতা। সঠিক আরাধনা করতে পারলে ওকে দিয়ে করানো যায় না এমন কাজ নেই। তোমাদের আগেও নীল গণেশের কথা বলেছি, তোমাদের মনে নেই।
যাই হোক, পরদিন সকালে জলখাবার খাওয়ার পর মুখুজ্যেমশাইয়ের ডাক এল। সরঞ্জাম তৈরি, এবার মাছ ধরতে যাওয়া হবে। কাছারিবাড়ির সামনে দেখি দেবদর্শন ব্যস্ত হয়ে কর্মচারীকে কী করতে হবে বোঝাচ্ছেন। একজন ভৃত্য পাঁচ-ছ’গাছা ছিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে, মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে নানামাপের কৌটো আর ভঁড়। তা থেকে মনোমুগ্ধকর। সব গন্ধ বের হচ্ছে। হঠাৎ সম্মিলিত গলার কোলাহল শুনে দেখি কয়েকজন ভদ্রলোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছেন। বুঝলাম এঁরাই দেবদর্শনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, এঁদের সামনেই তিনি মাছ ধরে দেখাতে চান।
রাণীদীঘি সত্যিই একটা বিশাল জলাশয়। এপার থেকে ওপারে দাঁড়ানো মানুষকে ভাল চেনা যায় না। যেখানে মাছ ধরতে বসা হবে সেখানে বাড়ির মেয়েদের স্নান করার জন্য বাঁধানো ঘাট, কয়েকখানা প্রাচীন আমকাঠালের ছায়ায় স্নিগ্ধ হয়ে আছে। দু-চারটে কলাপাতা পেতে দেবদর্শন মাছ ধরতে বসে গেলেন। একটু উঁচুতে পৈঠার ওপর শতরঞ্জি ভাঁজ করে বসলেন অতিথিরা। সকাল-বিকেলে সামান্য হিমের ভাব থাকলেও বেলা হবার সঙ্গে সঙ্গে রোদ্র বেশ চড়বড় করে বেড়ে ওঠে। কিন্তু এখানে সারাদিনই ছায়া থাকবে মনে হয়।
চুপ চুপ শব্দ করে জলে চার ছড়াচ্ছেন দেবদর্শন, গন্ধে চারদিক মম করছে। পুরুষ্টু কেঁচো দিয়ে টোপ গাঁথা হল, শক্ত মুঠোয় ছিপ ধরে তীক্ষ্ণ চোখ করে বসলেন বটে, কিন্তু জমিদারমশাই আজ কতটা সফল হবেন সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রইল। গত কুড়ি বছর ধরে মাছ ধরে আসছি, শরতের সকালে টোপে মাছ ঠোকরাতে খুব একটা দেখিনি।
দেবদর্শন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-ঠাকুরমশাইও একটা ছিপ নিয়ে বসে যান না, শুধু দেখবেন কেন?
–না, আজ আপনিই ধরুন! আজ আর হাত লাগাতে ইচ্ছে করছে না।
মাছ ধরতে ইচ্ছে করছিল না এমন নয়, কিন্তু ভাগ্যবশে ওঁর বদলে আমার ছিপে মাছ উঠলে উনি দুঃখ পেতেন। আর সত্যিকারের মেছুড়ে মাছ ধরা দেখতেও ভালবাসে। উনি বিশেষ পীড়াপীড়ি করলেন না। আমিও দেবদর্শনের পেছনে একখানা কলাপাতা পেতে বসে পড়লাম।
যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই ঘটতে চলল। দুপুরে খাওয়ার সময় পর্যন্ত একটা মাছও চারে এল না। একসময় ছিপ গুটিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে দেবদর্শন বললেন—চলুন, খেয়ে আসা যাক। তারপর আবার বসা যাবে। ততক্ষণ চার আর একটু জমুক–
আত্মীয়ের দলটিও একটু উসখুস করছিল, তারাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিচু স্বরে বললাম—চিন্তা নেই। খেয়ে এসে বসুন, মাছ পাবেন–
দেবদর্শন চমকে আমার দিকে তাকালেন, মুখে কিছু বললেন না, আমি একটু হাসলাম।
প্রথম হেমন্তের বেলা চট করে পড়ে আসে। খাওয়ার পরেই আর দেরি না করে। আবার রাণীদীঘির পাড়ে ফিরে আসা হল। ছিপ মুঠো করে বসে গেলেন দেবদর্শন।
আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম জমিদারমশাইয়ের সব আত্মীয়েরা এখনও এসে পৌঁছোয় নি। যারা এসেছেন তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন, এদিকে কারো তেমন মনোযোগ নেই। আমি ধুতির ভাঁজে লুকিয়ে রাখা নীল গণেশের মূর্তিটা বের করে দেবদর্শনের মাথার ওপর দিয়ে দীঘির জলে ছুঁড়ে দিয়ে বললাম-শ্বেতর্ক নির্মিতং গণনাথং পঞ্চান্তকং ওঁ অন্তরীক্ষায় স্বাহা।
দেবদর্শন চমকে উঠে ফিরে তাকালেন, তাঁর চোখে বিমূঢ় দৃষ্টি। বললেন—কে কী ফেলল জলে? এঃ, মাছ পালিয়ে যাবে যে! এতক্ষণে হয়ত চার একটু জমে আসছিল–
—ভাবনা নেই। ও আমি একটা জিনিস ফেলেছি—
–আপনি! সে কি! কী জিনিস?
উত্তরে বললাম—ঘুরে বসুন মুখুজ্যেমশাই। বাঁদিকের ছিপের ফাতনা কাঁপছে।
বড় মাছ। দু-তিনবার কেঁপে ফাতনা একেবারে নিতলি হয়ে গেল।
হর্ষধ্বনি করে আত্মীয়ের দল উঠে দাঁড়াল। ধনুকের মত বেঁকে গিয়েছে ছিপ, মাছ ছুটেছে দীঘির উত্তর-পশ্চিম কোণ লক্ষ্য করে। কিরকির আওয়াজ করে ঘুরে যাচ্ছে হুইল। গতকাল তামাক খেতে খেতে তার মাছ ধরার সরঞ্জাম দেখিয়েছিলেন দেবদর্শন। কলকাতায় তোক পাঠিয়ে অনেক খরচ করে কিনে আনা মূল্যবান বর্মী বাঁশের ছিপ, বিলিতি হুইল আর বঁড়শি—খাঁটি ইস্পাতের তৈরি। শক্ত মুগার সূতো, মথুরা থেকে আনানো ময়ূরের পাখার ফাতনা—যত বড় মাছই হোক, একবার গাঁথলে আর সহসা ছাড়া পাবার উপায় নেই।
প্রায় পৌনে একঘণ্টা খেলাবার পর হুইল গুটিয়ে ঘাটের কাছে মাছটা টেনে আনলেন দেবদর্শন। তাঁর গা বেয়ে ঘাম ঝরছে। কিন্তু মুখ উজ্জ্বল। বড় মাছ গেঁথেছে এ খবর রটে যাওয়ায় রাণীদীঘির পাড়ে ভিড় জমে গিয়েছে। অনেকক্ষণ লড়ে যদিও মাছটা নির্জীব হয়ে পড়েছে, তবু জলের ভেতর ও জিনিস বাঘের মত শক্তি ধরে। রঘু এবং আরও তিনজন লোক জলে নেমে পাঁজাকোলা করে জাপটে মাছটা ওপরে তুলে এনে ঘাটের পৈঠায় শুইয়ে দিল। অস্ফুট শব্দে ভিড় ঝুঁকে পড়ল সামনে।
চোদ্দ-পনেরো সের ওজনের বিশাল লালচে রুই। একটা বাছুরের মত বড়।
সবাই নানারকম প্রশংসাসূচক কথা বলছে, কেউ ফিতে এনে মাছটা মাপার কথা বলছে। আমি তাকিয়েছিলাম দেবদর্শনের দিকে। তিনি ভারি খুশি হয়েছেন। মানুষটির মনের মধ্যে কোনো ঘোরপ্যাচ নেই, এইটুকু কৃতিত্বতেই ভদ্রলোক তৃপ্ত।