বুঝলাম নীল আলোটা উনি দেখতে পাচ্ছেন না। না পাওয়ারই কথা।
বললাম—কিছু না। আজ শুক্লপক্ষের একাদশী পড়ে গিয়েছে, চাঁদের আলো সামান্য হলেও থাকা উচিত ছিল। এত অন্ধকার হল কীভাবে?
দেবদর্শন বললেন-চাঁদ আকাশে আছে ঠাকুরমশাই। পশ্চিমে হেলে পড়েছে কিনা, আমবাগানের আড়ালে বলে দেখতে পাচ্ছেন না—
–বড় অন্ধকার, তাই না?
—যা বলেছেন। নিজের বাড়িটাই দেখতে পাচ্ছি না—
এই জিনিসটা বরাবর আমাকে অবাক করেছে। স্পষ্ট, সুন্দর নীল আলোয় উদ্ভাসিত। হয়ে আছে মুখুজ্যেবাড়ি। কিন্তু আমি ছাড়া কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না। আমার মানসিক শক্তি খানিকটা দেবদর্শনের মধ্যে সঞ্চারিত করে ওঁকে আলোটা দেখাতে পারতাম, কিন্তু এ ধরণের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মুখখামুখি হওয়ার জন্য কিছুটা পূর্বপ্রস্তুতি দরকার। নইলে উনি ভয় পেয়ে যেতেন।
বৈঠকখানায় বসে দেবদর্শন বললেন—সারারাত তো জেগে, তাছাড়া কয়েকদিন ধরে আপনার পরিশ্রমও কম যাচ্ছে না। একটু ঘুমিয়ে নেবেন নাকি?
তখন ব্রাহ্মমুহূর্ত। পূব আকাশে প্রাক্-ঊষার হালকা আভাস। বৈঠকখানার পাশে একটা বড় জগডুমুর গাছের ডালে ভোরের প্রথম দোয়েলপাখি ডাকতে শুরু করেছে। রাত্তিরে না ঘুমোলেও ঠিক এইসময়টায় আর কোনো জড়তা থাকে না, ঈশ্বরের আশীর্বাদ। হয়ে মনের ভেতর পবিত্রতা জেগে ওঠে, সকালের আলো ফুটে ওঠে। বললাম—না মুখুজ্যেমশাই, এখন আর শোব না—
–বসুন তাহলে, গল্প করা যাক। আমিও শোবো না। রঘু, তামাক দিয়ে যা–
দুপুরে খাওয়ার পর দেবদর্শন বললেন—মাছ ধরার নেশা আছে?
—খুব। আমার গ্রামে আমি ছোটবেলা থেকে মেছো তারানাথ বলে বিখ্যাত। কেন বলুন তো?
—চলুন, কাল তাহলে রাণীদীঘিতে মাছ ধরা যাক। আমার শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন আত্মীয়েরও আসার কথা আছে, সবাইকে কাল রাত্তিরে লুচি আর মাছের কালিয়া খাওয়াবো–
বললাম–রাণীদীঘি কোথায়?
—বেশীদূর নয়। ওই আমবাগানটার পেছনে। বেশ গাছপালার ছায়ায় ঢাকা সুন্দর পরিবেশ। মনের মত পরিবেশ না হলে মাছ ধরে সুখ নেই, বলুন ঠাকুরমশাই?।
এই শেষের দফায় আমি দেবদর্শনকে একজন পাকা মেছুড়ে বলে চিনতে পারলাম। অনেক মাছ ধরাটা বড় কথা নয়, পরিবেশ এবং মাছ ধরার উদ্যোগটাই বড় কথা।
বললাম–ঠিক বলেছেন। দীঘিতে ভাল মাছ আছে? টোপে ঠোকরায়?
দেবদর্শন হাসলেন, বললেন—প্রচুর মাছ আছে। ও দীঘি জমিদারবাড়ির নিজস্ব সম্পত্তি, বাইরের কেউ ব্যবহার করে না। পালে-পার্বণে জাল ফেলা হয়, প্রয়োজনমত সামান্য মাছ রেখে বাকি আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। এমন অনেক মাছ আছে যাদের ওজন বিশ-ত্রিশ সের, গায়ে শ্যাওলা গজিয়ে গিয়েছে। তবে টোপে ঠোকরাবে কিনা সে তো অনেকটা কপালের ব্যাপার–
—জাল ফেলে দরকারমত মাছ ধরে নিতে পারেন তো? ছিপে যদি না আসে?
–না, আত্মীয়দের বলেছি নিজে মাছ ধরব। এখন জাল ফেলাটা—
বুঝলাম এখন কিছু মাছ অন্তত নিজে না ধরলে শ্বশুরবাড়ির মানুষদের কাছে তাঁর সম্মান থাকবে না। একটু ভাবনাও হল। শরৎকালের এই সময়টায় চারে মাছ আসবে কি? এটা ঠিক মাছ ধরার সময় নয়। দেবদর্শন মানুষটি বড় ভাল, নিজে মাছ ধরে আত্মীয়দের খাওয়াবেন—এই সামান্য সাধটুকু পূর্ণ না হলে মনে ভারি দুঃখ পাবেন। কী করা যায়?
বিকেলের ছায়া গাঢ় হয়ে এলে গ্রামের পথে একটু বেড়াতে বের হলাম। শরৎসন্ধ্যার একটা আলাদা স্নিগ্ধ রূপ আছে। ঝোপঝাড় থেকে কেমন সুন্দর মিষ্টি গন্ধ বের হয়, মাথার ওপর দিয়ে পাখিরা বাসার দিকে উড়ে যায়। মাঠে-প্রান্তরে হাল্কা কুয়াশা জমে, ঈষৎ হিমের ছোঁয়া আর বেলাশেষের আলো হঠাৎই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। একটা জিনিস কখনও লক্ষ্য করেছ? সন্ধ্যের সময় যত পাখি আকাশে ওড়ে তারা সব পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায়, উল্টোদিকে খুব একটা কাউকে যেতে দেখবে না। অর্থাৎ কোনও অজ্ঞাত কারণে পাখিরা দিনের বেলা নিজেদের বাসার পূর্বদিকে ঘোরাফেরা করে। কী করে তারা দিক চিনতে পারে কে জানে!
পথের বাঁকে একজায়গায় একটা বড় আকন্দগাছ প্রায় আমার মাথা ছাড়িয়ে লম্বা। বড় বড় চ্যাটালো, ফ্যাকাসে সবুজ পাতায় ভরপুর প্রাণশক্তি প্রকাশিত হয়েছে। সে গাছ থেকে বুড়ো আঙুলের মত মোটা আর কড়ে আঙুলের মত লম্বা কিছুটা ডাল ভেঙে নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখলাম। যাক, কাজ অন্তত কিছু এগিয়ে রইল।
সন্ধ্যে গাঢ় হতে মুখুজ্যেবাড়ি ফিরে এলাম। দেউড়িতে বসে বাতির কঁচ পরিষ্কার করছিল রঘু, তাকে বললাম—হাতের কাজটা শেষ করে আমাকে একটা নরুণ এনে দিতে পার?
—আজ্ঞে, নরুণ? নখ কাটবেন বুঝি? কাল সকালে নলিন পরামাণিককে পাঠিয়ে দেব?
—কারুকে পাঠাতে হবে না। তুমি একটা নরুণ আমাকে দিয়ে যাও—
কিছুক্ষণ পরে রঘু অতিথিশালার ঘরে এসে একটা চকচকে নরুণ দিয়ে গেল।
রাত্তিরে খাওয়ার পরে বসে বসে নরুণ দিয়ে আকন্দগাছের ডাল থেকে একটা ছোট্ট গণেশমূর্তি কুঁদে বের করলাম। আকন্দকাঠ নরম, তাই অসুবিধে হল না। দেখতে বেশ ভালই হল। গণেশমূর্তি বানানোর একটা সুবিধে আছে, নাদা পেট আর সামনে শুড় দুলিয়ে দিলেই গণেশ। খুব বড় শিল্পী হওয়ার দরকার পড়ে না। মোটামুটি আদল আনতে পারলেই জিনিসটা কী তা বোঝা যায়।
পূজো উপলক্ষ্যে কাছারি এখন বন্ধ। নায়েবমশাইকে বলেছিলাম একটা নীলের বড়ি আমাকে জোগাড় করে দিতে। উনি কাছারির দরজা খুলে লেখার কালি বানাবার একখানা বড়ি এনে দিয়েছিলেন বিকেলে। মাটির ভাঁড়ে কুঁজো থেকে জল ঢেলে তাতে বড়ি গুলে গাঢ় নীল কালি বানিয়ে তাতে গণেশমূর্তি ভিজিয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ। যখন তুললাম তখন সাদা আকন্দকাঠ রঙ টেনে কটকটে নীল হয়ে গিয়েছে।