বললাম—শুধু কাল নয়, আমি আরও তিনদিন থাকব, লক্ষ্মীপূজো দেখে তারপর ফিরব–
কী একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও করলেন না দেবদর্শন। বললেন—খুব ভাল কথা, বেশ তো, বাঃ!
কবিগান হয় দুই বিরোধী পক্ষ নিয়ে। দুই পক্ষের তুমুল লড়াইতে আসর জমে ওঠে। রাম গোস্বামীর ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তারা নিজেদের মধ্যেই দুটো দল করে নেয়। তারপর চলতে থাকে চাপান-উতোর। প্রথমে মনে হয় নিজেদের ভেতরে সাঁটে গাইছে, এ কি আর তেমন জমবে? কিন্তু কিছুদূর এগুনোর পর দু-পক্ষের হুঙ্কার আর তেড়ে ওঠা দেখে বোঝা যায় ভেতরে আপোস থাকুক আর নাই থাকুক, আসর এবং গান জিনিসটা তারা ভালই বোঝে। তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলে হাততালি দেবার রেওয়াজ ছিল না, তার বদলে মানুষ হরিধ্বনি দিত। এখন ঘন ঘন ‘হরি হরি’ শুনে বুঝলাম আসর জমে গিয়েছে।
কিশোরী জিজ্ঞাসা করল—আচ্ছা, সে সময়ে আসরে আলো করত কী দিয়ে? বিদ্যুতের তো প্রশ্নই ওঠে না, হ্যাজাক বা ডে-লাইটও বোধহয় আসেনি। অন্ধকারে নিশ্চয়। গান হত না—
তারানাথ বলল—ভাল প্রশ্ন করেছ। আলোর বিষয়টা সমস্যা ছিল ঠিকই, তবে ব্যবস্থা যা হত তা মন্দ নয়। মুখুজ্যেবাড়িতেই দেখেছি, সামিয়ানার নিচে বড় ঝাড়লণ্ঠন গোটাকতক ঝুলিয়ে দেওয়া হত। পঞ্চাশ, একশো বা দুশো কাচের পাত্রের মধ্যে বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হত। এমন দু-খানা ঝাড়ে যেখানে অভিনয় বা গানবাজনা হচ্ছে সেই মঞ্চ যথেষ্ট আলোকিত হত। দর্শকদের বসবার জায়গার মাথার ওপরে বড় বড় কাচের ফানুস টাঙানো থাকত, তার ভেতরে জ্বলত তেলের বাতি। পরবর্তীকালে মোমবাতি বাজারে আসায় এবং ক্রমে সুলভ হওয়ায় মোমবাতিও জ্বলত। তোমরা ভাবছ এতে আর এমন কী আলো হত, আসরের কাজ চলত কী করে? ব্যাপার কী জানো, আজকাল ইলেকট্রিক আলো দেখে দেখে তোমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ, তুলনামূলকভাবে সেকালের এইসব আলোর আয়োজন তোমাদের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হবে। কিন্তু তখন গ্রামের মানুষ রাত্তিরে ঘরের কাজ করত রেড়ির তেলের প্রদীপে, তাও বেশি তেল খরচ করার সামর্থ্য কারোরই ছিল না। সন্ধের পর খাওয়া সেরে সবাই শুয়ে পড়ত। সাড়ে-আটটায় গভীর রাত। উৎসবে অনুষ্ঠানে ধনীর বাড়ি নেমন্তন্ন পেয়ে সেখানে গিয়ে এই আলোর বাহার দেখেই তারা মুগ্ধ হয়ে যেত—যা তোমাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হচ্ছে। আমার বাবার কাছে শুনেছি, তার ছোটবেলায় প্রথম কেরাসিন তেলের বাতির ঔজ্জ্বল্য দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এ তো তবু ভাল, বলা যেতে পারে রীতিমত আধুনিক যুগ। আজ থেকে আশি-পঁচাশি বছর আগে কি হত জানো? আসরের চারদিকে কলাগাছের। মাথা কেটে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হত, তার ওপরে বসানো থাকত মাটির সরা। যাত্রা বা পালাগান আরম্ভ হলে সেই সরায় ধুনোর আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হত। ধুনোর আগুন বড় সাঙ্ঘাতিক, রাত্তিরে পথ হাঁটার জন্য ধুনোর মশালও তৈরি করার রেওয়াজ ছিল। ওই সরাগুলোতে আগুন জ্বলে উঠত দাউ দাউ করে, আলোয় আলো হয়ে যেত চারদিক। কয়েকজন তোক বগলিতে ধুনো নিয়ে আলোর তদারক করে বেড়াত। কোথাও আগুন কমে এলে বগলি থেকে মুঠো করে ধুনো তুলে সরায় ছুঁড়ে দিত, আবার আগুন জ্বলে উঠত আগের তেজে।
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলেছে তারানাথ, এবার দম নেবার জন্য থেমে সিগারেট ধরাল। মৌজ করে কয়েকটা লম্বা টান দিয়ে বলল—তোমরা আলোর কথা তুললে, কিন্তু অত বড় আসরে দর্শক-শ্রোতারা গায়ক বা অভিনেতার গলা শুনতে পেত কী করে সে কথা জিজ্ঞাসা করলে না। আজকাল দেখছি বাজারে লাউডস্পীকার বলে যন্ত্র উঠেছে, সে যন্ত্রের সামনে মুখ রেখে কথা বললে চোঙের মধ্যে দিয়ে বিকট আওয়াজ বেরোয়। সে যুগে স্বপ্নেও এমন কাণ্ডের কথা কেউ ভাবেনি। তখন কী করত মানুষ?
বললাম-এটা তো সত্যিই তেমন করে ভাবিনি। কী করত তারা?
তারানাথ হেসে বলল—তোমরা ভাবছ তারানাথ চক্কোত্তি আবার একখানা অসম্ভব। কিছু কলাকৌশলের কথা বলবে, শুনে সবার তাক লেগে যাবে। না হে, তেমন কোনও উপায় ছিল না সেকালে। কবিয়াল বা যাত্রার অভিনেতার গলার জোরে দর্শকদের সংলাপ শোনাতে হত। আমি তেমন কয়েকজনকে দেখেছি। বাপরে, কী তাদের চেহারা, কী তাদের সাগরের গর্জনের মত গলার আওয়াজ! নৃপেন সেন্নাম ছিল আমাদের ছোটবেলার নামকরা অভিনেতা। সে যখন রাবণের ভূমিকায় নেমে হুঙ্কার ছাড়ত, আসরে বসে থাকা মায়েদের কোলে ঘুমন্ত বাচ্চারা জেগে উঠে তারস্বরে কান্না জুড়ে দিত। বুকের কাপড় সরিয়ে মায়েরা ছেলের মুখে ইয়ে গুঁজে দিয়ে তবে তাদের শান্ত করত। শুনেছি আসরে বাচ্চারা বেশি কাঁদলে বিরক্ত শ্রোতারা তাদের কান্না থামাবার সহজ উপায়টা একযোগে চিৎকার করে মায়েদের বাতলেও দিত।
প্রায় শেষরাত্তিরে আলো ফোটবার কিছু আগে আসর ভাঙলো। দেবদর্শন আর আমি পূজোমণ্ডপ থেকে হেঁটে আসছি কাছারিবাড়ির দিকে, মাঝখানে জমিটুকু ঘন অন্ধকার, হঠাৎ দেউড়ির ওপারে দেবদর্শনের ভদ্রাসনের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলাম। এ সমস্ত বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে একটা মৃদু শান্ত নীল আলোর আভা।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। লক্ষণ, প্রতিলক্ষণ, দৈব, কূটপ্রসার—এসব নিদর্শন বিচার করেই আমাদের চলতে হয়। নীল আলোটা দেখে বুঝলাম এই বাড়িকে ভগবান আশীর্বাদ করেছেন। এখানে কিছুদিনের ভেতর খুব ভাল কিছু একটা ঘটবে।
০৯. আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে
আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে দেবদর্শনও দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—কী হল ঠাকুরমশাই? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে?