পুরো দলটা আবার ফিরে এল মুখুজ্যেবাড়ির পূজোপ্রাঙ্গণে। মূর্তিহীন বেদীতে মিটমিট করে একটা প্রদীপ জ্বলছে। অতগুলো মানুষ ফিরে এল, কিন্তু পরিবেশে কীসের যেন একটা হাহাকার। কী একটা খুব আনন্দের জিনিস যেন এই একটু আগেও ছিল, এখন আর নেই। ঢাক থেমে গিয়েছে, পুরোহিত সুধীর ভট্টাচার্য ঘটে আম্রপল্লব ডুবিয়ে সবার মাথায় শান্তিজল ছিটিয়ে দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। দেবদর্শনের কাছে শুনেছি এই সুধীর ভট্টাচার্যেরই পূর্বপুরুষ হচ্ছেন দীনদয়াল ভট্টাচার্য, মুখুজ্যেবাড়ির তৎকালীন পুরোহিত, যিনি গড়ের তোপ সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
বারবাড়ির উঠোনে পরপর পাঁচখানা উনুনে রান্না চেপেছে। লোহার চাদর দিয়ে তৈরি বিশাল কড়াইতে মাংস কষা হচ্ছে। দেবদর্শনের কাছে শুনলাম চারমণ মাংস রান্না হচ্ছে, আর দেড়মণ ময়দার লুচি। নিবারণ ময়রাকে বায়না দেওয়া হয়েছিল, সে দু-মণ কড়াপাকের ছানার গজা বানিয়ে দিয়েছে। যারা বিসর্জনের মিছিলে গিয়েছিল তারা আর ফিরে যায়নি, সামিয়ানার নিচে বসে গল্পগুজব করছে। এখন একটু একটু করে আরও মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে। খাওয়াদাওয়া মিটলে মাঝরাত থেকে কবিগান হবে। নবদ্বীপ থেকে রাম গোস্বামীর দল এসে পৌঁচেছে বিকেল নাগাদ, এখন তারা এক কোণে গোল হয়ে বসে তামাক খেতে খেতে বিশ্রাম করছে। পাশে তাদের যন্ত্রপাতি রাখা আছে। উৎসাহী মানুষেরা তাদের কাছে ঘুরঘুর করছে আলাপ জমানোর জন্য, কিন্তু তারা খুবই গম্ভীর লোক, বাজে আলাপ করে নিজেদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে রাজি নয়। চোখ বুজে ঝিমোনোর ভান করছে।
আর একটা পাসিং শো ধরিয়ে তারানাথ বলল—আমার গল্প একটু ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে, না? তবু মন দিয়ে শোনো, এসব দিনকাল চলে যাচ্ছে, তোমরা আর দেখতে পাবে না। শুনে রাখো, পরে ছেলেপুলেদের গল্প বলতে পারবে। বাংলার উৎসব ক্রমেই চেহারা বদল করছে। তাছাড়া আড্ডার তো এই নিয়ম, ধরাবাঁধা পথে গল্প। এগোয় না। আচ্ছা তোমরা একটু বোসো, আমি ভেতরবাড়ি থেকে আর একবার চায়ের কথা বলে আসি–
এখান থেকে হাঁক দিয়েই চায়ের ফরমাশ করে দেওয়া যায়, তারানাথ সচরাচর তাই করে থাকে। কিন্তু সে বিচক্ষণ মানুষ, আমরা তার সামনে ধূমপান করি না, তাই সে মাঝে মাঝে এটা-ওটা অছিলা করে উঠে যায়। আমরাও বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়ে আসি। তারানাথ উঠে ভেতরে যেতে কিশোরী বলল—চল হে, চটপট একটু ধোঁয়া টেনে আসি–
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা সিগারেট ধরালাম। মট লেনের একটু ভেতরদিকে তারানাথের বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে খুব দূরে নয়, কিন্তু রাস্তার কোলাহল এপর্যন্ত এসে পোঁছয় না। প্রাচীন কলকাতার একটা শান্ত, স্নিগ্ধ কোণে তারানাথ থাকে। পলস্তারা খসে যাচ্ছে, নোনা-ধরা দেওয়াল, সদর দরজার কাঠ জীর্ণ হয়ে ফাঁক দেখা দিয়েছে। তবু তারানাথের গল্পের মত পুরনো দিনের চাদর মুড়ি দিয়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে। আধুনিক যুগ একে না ছুঁয়ে পাশ দিয়ে এড়িয়ে চলে গিয়েছে।
কিশোরী বলল—চার-পাঁচ বছর আগেও তারানাথ চক্কোত্তিকে আমরা চিনতাম না। মনে আছে, আমিই তোমাকে প্রথম নিয়ে আসি? তুমি তো বুজরুক ভেবে প্রথমে আসতেই রাজি হওনি। আর আজ? হপ্তায় অন্তত একটা দিন না এলে মন ছটফট করে।
—ঠিক বলেছ।
–আসলে কী জানো, লোকটা গল্প বলে দারুণ সুন্দর। গল্পটা সত্যি না মিথ্যে, সে প্রশ্ন মনেই আসে না। ও একটা সম্মোহনের মত ব্যাপার–
সিগারেট শেষ করে দুজনে ভেতরে এসে বসলাম। একটু পরেই তারানাথও ফিরে এল। গলাখাঁকারি দিয়ে বলল—ঠাণ্ডা মত লেগেছে, আদা দিয়ে চা করতে বললাম। সেদিন ছেলেটার একটু সর্দিজ্বর মত হয়েছিল, গলির মোড়ের ভূপেন ডাক্তার এসে জেফরল নামে কাশির সিরাপ দিয়ে গেল। অবশ্য আমার কাছ থেকে ভিজিট বা ওষুধের দাম নেয় না, ওর ছেলের কোষ্ঠী আমি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওইসব রঙচঙে ডাক্তারি জল খাওয়ার চাইতে খুচখাচ অসুখে দেশী টোটকায় কাজ হয় অনেক বেশি। সর্দিকাশি হলে আমি আদা দিয়ে চা খাই, বড়জোর মুখে দু-একদানা কাবাবচিনি রাখি। তাতেই দিব্যি সেরে যায়। কাবাবচিনি চেন তো? ওই যে, ছোট্ট ল্যাজওয়ালা গোলমরিচের মত দেখতে–
চা এসে গেল। সুরুৎ করে চুমুক দিয়ে তারানাথ বলল—আঃ! আদা-চায়ের কি তুলনা আছে? হ্যাঁ, গল্পটা যেন কোন পর্যন্ত বলেছিলাম?
কিশোরী বলল—মুখুজ্যেবাড়িতে চার মণ মাংস রান্না হচ্ছে—
-হ্যাঁ। তারপর রাত সাড়ে-দশটা নাগাদ সামিয়ানার নিচে সারি সারি পাত পড়ে। গেল। যজ্ঞিবাড়িতে পরিবেশন করবার জন্য পাড়াগাঁয়ে একদল দক্ষ লোক থাকে। এখানেও তেমন কিছু লোক কোমরে লাল গামছা বেঁধে কাজে নেমে পড়েছে। বড় কড়াইতে কলকল করছে ঘি, উঁচলো-মুখ বাঁখারির আগায় গেঁথে ভোলা হচ্ছে লুচির গোছা। গরম ঘি আর সদ্য ভাজা লুচির গন্ধে সমস্ত জায়গাটা আমোদ করেছে। এক একজন লোক যে পরিমাণ লুচি খাচ্ছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দেড়মণ ময়দায় শেষপর্যন্ত কুলোবে কিনা কে জানে। এখনকার তুলনায় সে ছিল অনেক সস্তাগণ্ডার বাজার, গাওয়া ঘি-তে লুচি ভেজে খাওয়াটা কোনও আহামরি ব্যাপার ছিল না। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের সের তখন দশ আনা কী বারো আনা, ভাবতে পারো? তবু একথা সত্যি যে, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ছিল গরীব। যতই সস্তা হোক, গাওয়া ঘিয়ে ভেজে লুচি খাওয়া তাদের কাছে স্বপ্ন ছিল। এসব দামী খাওয়া-দাওয়া একটু উচ্চবিত্ত পরিবারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকত। পালেপার্বণে জমিদারবাড়িতে নেমন্তন্ন পেলে এরা কোমরের কষি ঢিলে করে খেতে বসে। খাওয়ার পর্ব চুকতে ঢুকতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা হল। একটা থেকে আরম্ভ হল কবিগানের আসর। সামনের সারিতে একটু কোণের দিকে আমাকে নিজের পাশে বসালেন দেবদর্শন। বললেন—ঠাকুরমশাই, কালকের দিনটাও থেকে যাবেন কিন্তু–