সন্ধিপূজো শেষ হল। মেয়েরা গলবস্ত্র হয়ে ঠাকুরপ্রণাম করছেন, লোকজন সব উত্তেজিত হয়ে গড়ের তোপের প্রসঙ্গ আলোচনা করছে। এতদিনের কিম্বদন্তী, কিন্তু সেভাবে কেউ শোনেনি কামানের শব্দ। গ্রামের সরল বিশ্বাসী মানুষের মনে আলোড়ন তৈরি করবার মত ঘটনা এটা। মুখুজ্যেবাড়ির দুর্গোৎসবের মাহাত্ম্য নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হল।
দেবদর্শন প্রণাম সেরে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখে জল।
–শুনলেন ঠাকুরমশাই?
—শুনলাম। আপনার নিমন্ত্রণ রেখে ভালই করেছি।
—চলুন, আমরা বৈঠকখানায় গিয়ে বসি। রঘু, আমাদের তামাক দে-আর প্রসাদ। নিয়ে আয়।
উৎসব উপলক্ষে বাড়ি সাজানো হয়েছে দেখলাম। বৈঠকখানার দরজায় ঝুলছে আমপাতা আর শোলার কদমফুল। ভেতরে তক্তাপোশে গদির ওপর নতুন ধপধপে ফরাস পাতা, ধারে ধারে কটা মোটা গির্দা। আমরা গিয়ে বসার একটু পরেই রঘু দুজনকে তামাক দিয়ে গেল। পেছনে এল পুরোহিতের তন্ত্রধার, তার হাতে দুখানা কাঠের বারকোশে পূজোর প্রসাদ। দেবদর্শন বললেন—প্রসাদ খেয়ে আপাতত চালান ঠাকুরমশাই। দুপুরে খেতে কিন্তু দেরি হবে। লোকজন সব এতক্ষণ সন্ধিপূজো দেখছিল, এইবার রান্না চাপাবে
বললাম—তা হোক, আমার কোনও তাড়া নেই।
—আমাদের কিন্তু দেবীপুরাণ মতে পূজো, এই কদিন নিরামিষ খাওয়া চলছে, সেই বোধনের দিন থেকে। একেবারে দশমীর দিন বিসর্জন সেরে এসে রাত্তিরে লুচি-মাংস খাওয়া হবে সকলে মিলে। আপনার হয়ত কষ্ট হবে
—কিছু অসুবিধে হবে না। ভালমন্দ জিনিস খেতে খুব ভালবাসি ঠিকই, আবার নুনভাত খেতেও ভালই লাগে। স্বাদ জিনিসটা জিভে নয় মুখুজ্যেমশাই, হৃদয়ে।
দু-একজন করে গ্রামের বৃদ্ধ প্রতিবেশী বৈঠকখানায় এসে বসতে শুরু করলেন। সাধারণ মানুষেরা প্রসাদ খেয়ে সামিয়ানার নিচেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গল্পগুজব করতে লাগল। সবাই দুপুরে খেয়ে বাড়ি যাবে, সন্ধেবেলা এসে আরতি দেখবে, এবং আবার রাত্তিরের খাওয়া সেরে ফিরবে। সমস্ত গ্রামটায় উৎসবের আবহাওয়া এবং সেটা মুখুজ্যেবাড়িকে কেন্দ্র করে।
দেবদর্শনের বাড়ির একটা সুন্দর প্রথা দেখলাম। যেমন, দুপুর আর রাত্তিরের সামুদায়িক ভোজ। সবাই মিলে সামিয়ানার নিচে সারি দিয়ে বসে একই খাবার খাওয়া হচ্ছে। জমিদার বলে দেবদর্শন আলাদা বসেন নি, বা তাকে আলাদা করে বিশেষ কোনও খাবারও দেওয়া হচ্ছে না। রান্না হয়েছে মোটা লালরঙের আউশ চালের ভাত। কী মিষ্টি তার স্বাদ! সঙ্গে কলাইয়ের ডাল, কাঁচকলা ভাজা, আলু-বেগুন-কুমড়ো-ঝিড়ে-আঁটাশাকগুড়িকচু দিয়ে অনবদ্য একটা ঘাট, আমড়ার চাটনি আর পাতলা পায়েস। কোনও জমিদারবাড়ির পক্ষে নিতান্তই সামান্য আয়োজন, কিন্তু সমবেত মানুষজন সোনা হেন মুখ করে আনন্দের সঙ্গে তাই খাচ্ছে। প্রথম কারণ, জমিদারবাবুর প্রতি ভালবাসা। দ্বিতীয় কারণ, একসঙ্গে বসে খাওয়ার আনন্দ। দুটো কারণই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
খেতে খেতে দেবদর্শন বললেন-রাত্তিরে হবে লুচি, আলু-কুমড়োর তরকারি আর পায়েস। পায়েসটা একটু জোলো লাগছে, না? কী আর করা যাবে বলুন, এতগুলো মানুষের জন্য আয়োজন। আমাদেরও তো সে দিন আর নেই। তবে হ্যাঁ, আগামীকাল দুপুরে আপনাকে একটা জিনিস খাওয়াব। সামান্য জিনিস, তবে খেতে ভারি ভাল
বললাম-কী জিনিস?
—আমরুল পাতা, রাঙাআলু আর আম-আদা দিয়ে তৈরি চাটনি। আমাদের এই অঞ্চল ছাড়া জিনিসটার চল দেখিনি বিশেষ কোথাও–
সরল মানুষ দেবদর্শন, আনন্দে পূর্ণ মনের মানুষ। এই নিয়ে মাত্র দুবার ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ, তবু যেন একটা আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করলাম। সকলের সঙ্গে আনন্দ করে পূজোর বাকি দুটো দিন কেটে গেল। দশমীর দিন দুপুরের পর থেকে বৌঝির দল ভিড় করে ঠাকুরবরণ করতে শুরু করল। দু-থাক তক্তা দিয়ে প্রতিমার সামনে উঁচু মঞ্চের মত করে দেওয়া হয়েছে, তার ওপরে দাঁড়িয়ে মেয়েরা ঠাকুরের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে, মুখে চুইয়ে দিচ্ছে সন্দেশ। নিজেদের মধ্যে এ-ওর কপালে সিঁদুর লেপে দিচ্ছে, শাঁখা আর নোয়ায় মাখিয়ে দিচ্ছে। এই লোকাচারের নাম সিঁদুর খেলা। আমাদের সমাজে মেয়েদের সমস্ত উৎসব-আনন্দই প্রায় পর্দার আড়ালে পালিত হয়। এই একটা দিন তারা অসঙ্কোচে বেরিয়ে আসে বাইরে। দেখতে ভারি ভাল লাগে তাদের স্বতোৎসারিত। আনন্দের প্রকাশ। বুঝতে পারা যায় আড়ালে থাকা এই বিপুল নারীশক্তির বলেই ঠিকঠাক চলছে সমাজটা।
সারা গাঁয়ের লোক মিছিল করে প্রতিমা নিয়ে বেরুল বিকেলবেলায়। তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে। ছায়া গাঢ় হচ্ছে আম-জামবাগানের ফাঁকে ফাঁকে। বাতাসে হিমের ছোঁয়া, কার্তিক মাসের প্রথম দিকের স্নিগ্ধ হিম। হেমন্তকাল আসতে আর দেরি নেই।
বাঁশের ওপর পাশাপাশি তক্তা সাজিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার ওপর ঠাকুর রেখে কাঁধে নিয়েছে বাহকেরা। হাতে তাদের মশাল, সন্ধে আর একটু গাঢ় হলেই জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। নাচতে নাচতে আর দেবীর নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে পুরো দলটা এসে দাঁড়াল নদীর ঘাটে। সেখানে ভাসানের জন্য পাশাপাশি দু-খানা নৌকো বেঁধে চওড়া বেদীর মত করা হয়েছে। ঠাকুরসুদ্ধ তক্তা রাখা হল সেই নৌকোর ওপরে, সঙ্গে উঠল দশ-বারোজন বলিষ্ঠ লোক আর ছ-জন ঢাকি। ঘাট থেকে ছেড়ে ধীরগতিতে নৌকো মাঝনদীতে গিয়ে দাঁড়াল। তখন অন্ধকার নেমেছে ঘোর হয়ে, নৌকোর ওপর জ্বলে উঠেছে মশাল। হঠাৎ সবগুলো ঢাক বেজে উঠল দ্রুততালে, নদীর পারে আর নৌকোর ওপরে লোজন চিৎকার করে উঠল—আবার এসো মা, অাবার এসো! আস্তে আস্তে দু-দিকে সরে গেল দুই নৌকো, প্রতিমাবাহকেরা মাঝখানের বাঁধনের দড়ি কেটে দিয়েছে। সোজাসুজি দাঁড়ানো অবস্থায় জলে ডুবে গেল দেবীপ্রতিমা। পাগলের মত বাজছে ঢাক, পাগলের মত চেঁচাচ্ছে মানুষ। ধকধক করে জ্বলছে মশাল। বিসর্জন হয়ে গেল।