দেবদর্শন প্রবীণ জমিদার বটে, কিন্তু সেকেলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নন, তাঁর মনের মধ্যে বেশ উদার আলোহাওয়া খেলে।
গল্পে গল্পে সেদিনটা ভালই কেটে গেল। পরের দিন আবার বেরিয়ে পড়লাম পথে।
পথটাই আমার ঠিক জায়গা, ঠিকঠাক খাপ খেয়ে যায়। চিন্তাহীন, মুক্ত আনন্দে ভরা দিনগুলো। কখনও ঝড়-বৃষ্টি, কখনও নীল আকাশে ডানা ছড়ানো চিলের ওড়াউড়ি। পড়ন্ত বেলায় রাস্তার ধারের লতাপাতার ঝোপ থেকে মন-কেমন-করা কটু গন্ধ ওঠা। গ্রামের মুদিখানা থেকে মুড়ি আর মুড়কি কিম্বা বাতাসা কিনে খাওয়া, যেখানে-সেখানে রাত্তিরের আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। তোমরা যারা সংসারী মানুষ তারা এ জীবনটাকে ঠিক উপলব্ধি করতে পারবে না। তবে আবার বলছি—মনে বল আর সাহস থাকা চাই, দুর্বল পুতুপুতু মনের লোক এ আনন্দ পাবার যোগ্য নয়।
কয়েকমাস ঘুরে বেড়ালাম বহু জায়গায়, অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতাও হল। তার মধ্যে একটা তো জমিয়ে গল্প বলার মত। কিন্তু সেটা আজ বলব না, আজ বরং মুখুজ্যেবাড়ির গল্পটা শেষ করি।
শরৎকাল এসে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই দুর্গাপুজো আসছে। একটা কালীবাড়ির নাটমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলাম সে রাত্তিরে। বেশ পরিচ্ছন্ন জায়গা, মশাটশা বিশেষ নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম ঘুম ভাব ঘনিয়ে এল। সারাদিন পথশ্রমের পর ঘুম আসার অনুভূতি ভারি আরামের।
হঠাৎ সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে কানের কাছে কে যেন বলল কাল সকালেই রওনা হও। মুখুজ্যেবাড়ির পূজোয় এবার তোমার থাকা দরকার।
চমকে উঠে বসলাম–কে? কে বলল কথাটা? তারার আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে নাটমন্দির। কই, জনপ্রাণীও তো নেই কোথাও! অথচ আমি পরিষ্কার শুনেছি–
উঠে একবার চারপাশটা ঘুরে দেখে এলাম। না, সত্যিই কেউ কোথাও নেই। তাহলে?
তারপরেই হঠাৎ একটা ধাক্কার মত মনে হল—এই গলার স্বরের অধিকারীকে আমি চিনি! তার নাম অমর। অমরজীবন। আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের পর্বে পর্বে সে জড়িয়ে গিয়েছে। রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা তার পরিচয়, আকাশের নক্ষত্রদের মত সে প্রাচীন। তার নির্দেশ আমাকে মানতেই হবে।
অনেক রাত্তির অবধি নাটমন্দিরের মেঝেতে থু হয়ে বসে রইলাম। গলাটা শুনতে পেয়ে মনে কোনও ভয় বা আশঙ্কা হল না, বরং মৃদু তৃপ্তি আর শান্তিতে মন ভরে গেল। যেন কয়েকবার হারিয়ে যাওয়া কোন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি। ঠিক করলাম পরের দিনই রওনা দেব জয়তলায়।
ঘুরতে ঘুরতে দেড়খানা জেলা পার হয়ে চলে এসেছিলাম, কাজেই ফিরতে বেশ সময় লাগল। খুব প্রাণপণ হেঁটেও পূজো আরম্ভ হবার আগে মুখুজ্যেবাড়ি পৌঁছতে পারলাম না। সপ্তমীর দিন সন্ধেবেলা পৌঁছলাম দানাবাড়ি নামে একটা গ্রামে, সেখান থেকে জয়তলা বারো মাইল পথ। খুব ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়লে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাব।
পরের দিন মহাষ্টমী। অন্ধকার থাকতেই ঘুম ভেঙে উঠে মুখহাত ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যে গোয়ালবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সে বাড়ির কর্তাও আমাকে এগিয়ে। দেবার জন্য গল্প করতে করতে অনেক দূর এল। শরৎকালের ভোর, বাতাসে সামান্য হিমের স্পর্শ। গ্রামের সীমানায় একটা বাড়ির উঠোনে গাছের তলায় আলো করে ছড়িয়ে। আছে শিউলি ফুল। তার পবিত্র গন্ধ সে জায়গার বাতাসকে আমোদিত করে রেখেছে। এখান থেকেই আমার সঙ্গী উদ্ধব ঘোষ প্রণাম করে বিদায় নিল। আমিও জোরে পা চালালাম।
পথে বারদুই সামান্য বিশ্রাম করে ঠিক বেলা দুপুরে জয়তলা পৌঁছলাম। দূরে মুখুজ্যেবাড়ির পূজোর ঢাক বাজছে। গ্রামের রাস্তাতেও খুব বেশি লোক নেই, দল বেঁধে সবাই জমিদারবাড়ি পূজো দেখতে গিয়েছে। পথের বাঁক ঘুরেই সামনে মুখুজ্যেমশাইয়ের। বাড়ি। কাছারি আর অন্দরমহলের মাঝখানে বিরাট উঠোনে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, তার নিচে অন্তত শ-তিনেক লোক হাতজোড় করে প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বসে। আমি মণ্ডপে ঢুকতেই সমস্ত কোলাহল থেমে গিয়ে অতবড় আসরে স্তব্ধতা নেমে এল। সন্ধিপূজা সমাগত।
আসরের একেবারে অপর প্রান্তে ঠাকুরদালানে প্রতিমার সামনে একশো আটখানা পেতলের প্রদীপ ধকধক করে জ্বলছে। পুরোহিত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন লোহার বেড়ের ওপর বসানো নতুন জলভরা মাটির হাঁড়ির দিকে। তার তলার ফুটো দিয়ে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। সমস্তটা জল বেরিয়ে গেলে সন্ধিপূজো শুরু হবে। ভাল সময়ে পৌঁছলাম মুখুজ্যেমশাইয়ের বাড়িতে।
ওপাশ দিয়ে ক-খানা বারকোশ হাতে করে রঘু কোথাও যাচ্ছিল, সে আমাকে দেখতে পেয়ে একগাল হাসল, তারপর আসরের সামনে যেখানে দেবদর্শন বসে আছেন সেখানে গিয়ে নিচু হয়ে বাধহয় আমার কথা বলল। দেবদর্শন চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
তাঁর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হওয়ামাত্র দূর থেকে ভেসে আসা মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট কামানের গর্জন শুনতে পেলাম। আসরের সব মানুষই নিশ্চয় শুনতে পেয়েছিল, জয়ধ্বনি দিয়ে তারা একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল সামিয়ানার তলায়। গড়ের তোপ! গড়ের তোপ শোনা গিয়েছে!
কেবল পুরোহিতমশায় অবিচল। হাঁড়ির জল শেষ হওয়ামাত্র তিনি হাত তুললেন। মেঘের গর্জনের মত গুড়গুড় করে বেজে উঠল ঢাক।
সন্ধিপূজো শুরু হল।
০৮. শাঁখ আর ঘণ্টা বেজে উঠল
শাঁখ আর ঘণ্টা বেজে উঠল, ঢাক তো বাজছেই। বাড়ির আর সমাগত গ্রামের মেয়েরা উলু দিচ্ছে। কামারের হাতে ঝকঝকে খাড়া উঠছে নামছে, এঁটেল আর বালিমাটি মিশিয়ে তৈরি বেদীর ওপরে পরপর বলি হয়ে যাচ্ছে একশো আটটা চালকুমড়ো, কলা, আখ, সুপুরি। মুখুজ্যেবাড়ির পূজো হয় দেবীপুরাণ অনুযায়ী, পশুবলি এ বাড়িতে নিষেধ। তার। মধ্যে সুপুরি বলি ব্যাপারটা দেখার মত। মাটির বেদীতে রাখা ওইটুকু একটা জিনিসের ওপর অতবড় ভারি খাড়া নির্ভুলভাবে নামিয়ে আনা রীতিমত কঠিন কাজ। সুপুরি শক্ত এবং গোল জিনিস, খাঁড়া যথেষ্ট ধারালো এবং কামার যথেষ্ট কুশলী না হলে ফলটা ফকে পাশে সরে যাবে। তা হলে মহা অকল্যাণ। কিন্তু বলি হয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।