গোটা দু-চার টান দিয়ে কলকে ঠিকমত চালু করে দেবদর্শনবাবু আবার বলতে শুরু করলেন—মোটামুটি এই আমাদের পরিবারের গল্প ঠাকুরমশাই। সাধারণ গল্প, বড় পরিবারের পতনের কাহিনী আপনি নিশ্চয় আগেও শুনেছেন। আমারও বিশেষ কোনও দুঃখ নেই, কারণ আমি লোভী মানুষ না। সামান্য যেটুকু আছে তাতে সম্মান বাঁচিয়ে হয়ত বাস করা যায়, কিন্তু তার বেশি কিছু না। অথচ আমার ইচ্ছে ছিল এই বাড়িটা একটু মেরামত করার। সে তো খুব কম পয়সায় হবার নয়, বুঝতেই পারছেন। এই হাতির মত বাড়ি। আমি চোখ বুজলে হয়ত পরিবারের কে কোথায় ছিটকে যাবে, যারা থাকবে তাদের পক্ষেও এতবড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হবে না। তবু এ আমার ভদ্রাসন, শৈশবের স্মৃতি দিয়ে জড়ানো বাড়ি। আমি থাকতে এ বাড়ি ভেঙে পড়ে যাবে?
মানুষটার দুঃখ আমি বুঝতে পারছিলাম। জগতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল পারিবারিক ঐতিহ্য আর পুরনো স্মৃতিকে ত্যাগ করা। বাস্তব দুনিয়ার নির্মম পেষণে সেটাও যখন স্বীকার করতে হয়, তখন সহৃদয়, সজ্জন মানুষের মুখের চেহারা বোধহয় দেবদর্শন মুখুজ্যের মত করুণ-বিধুর হয়ে আসে।
মুখুজ্জেমশাই বললেন—আপনাকে কেন থেকে যেতে বললাম জানেন? আমার ধারণা আপনার কৃপায় বোধহয় আমার সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে।
অবাক হয়ে বললাম—আমি? আমি কী ভাবে—
দেবদর্শন বললেন-আজ থেকে মাসখানেক আগে একজন পাগলামত ভবঘুরে অতিথি দিনদুয়েক অতিথিশালায় এসে ছিল। পাগলামত বলছি বটে, কিন্তু তার চেহারার ভেতর কী যেন একটা ছিল, যাতে তাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভালো বংশের সন্তানের মত হাবভাব, উজ্জ্বল চোখ। দোষের মধ্যে ঐ একটু মাঝেমাঝে অসংলগ্ন কথা বলা। সে বলেছিল আমাদের অতিথিশালায় কিছুদিনের মধ্যেই এমন একজন লোক আসবে যার মাধ্যমে আমাদের পরিবারের বর্তমান আর্থিক সমস্যা অনেকটা লাঘব হয়ে যাবে। আপনি সাধক মানুষ, ভাবলাম আপনিই যদি সেই লোক হন? মা আমার মনের মধ্যে তখন একটা মৃদু ঘণ্টার শব্দ বেজে উঠেছে। নৈঋত কোণে ঝড়ের মেঘের মত দ্রুত সেটা বিরাট অবয়ব নিতে লাগল। বললাম—অসংলগ্ন কথা বলত কী রকম? অসঙ্গত কিছু?
-না না, আদৌ তেমন নয়। আলোচনা করতে করতে হঠাৎ হয়ত এমন একটা কথা বলল যার কোনও মানেই হয় না। একটা ছড়া তো খুব বলত–
বললাম—কী ছড়া?
—সে থাক, সে শুনলে আপনি হাসবেন। পাগলের কাণ্ড–
—বলুন মুখুজ্যেমশাই, এর ওপরেই হয়ত আপনাদের পরিবারের ভাগ্য-পরিবর্তন নির্ভর করছে।
দেবদর্শন চমকে আমার দিকে তাকালেন, বললেন—আপনি তাই মনে করেন?
হতে পারে। বলুন আপনি—
দেবদর্শন বললেন—প্রথম যেদিন শুনি, সেদিন জিনিসটার কোনও গুরুত্ব দিইনি। সকালবেলা কাছারিতে বসে হিসেবপত্র দেখছি, এমনসময় লোকটি হঠাৎ এসে ঘরের। দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল–
দিকে দিকে সাগরেতে ভাই,
চোখে চোখে চাঁদ খুঁজে পাই।
আমি অবাক, নায়েবমশাই অবাক, গোমস্তা-মুহুরীরা অবাক! বলে কী লোকটা? পাগল নিশ্চয়, কিন্তু পাগলে কি গুছিয়ে ছড়া বলে?
যাই হোক, এরপর সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—এই অতিথিশালায়, এই বাড়িতে একজন আসবে শিগগীরই। সাধক মানুষ। তাকে এই ছড়া শুনিও। সে তোমার উপকার করবে–
এই ঘটনার পর আর একটা দিন সে আমাদের বাড়ি ছিল। ওই একটা দিন সে প্রায়ই ঘুরে ঘুরে আমার কাছে আসত আর বলত—মুখস্থ করে নাও, মুখস্থ করে নাও। খুব কাজে দেবে—
দেবদর্শন থামলেন। বললাম—এ লোকটির নাম কী? নাম বলেছিল?
মুখুজ্যেমশাই বললেন—বলেছিল। ব্রাহ্মণসন্তান। নাম অমরজীবন ভট্টাচার্য।
যতটা চমকানো উচিত ছিল ততটা চমকালাম না। আমি একরকম বুঝতেই পেরেছিলাম উনি এই নাম বলবেন।
কাছারিবাড়ির কার্নিশে বাসাবাঁধা পায়রার দল গলার মধ্যে কুমকুম শব্দ করছে। সুন্দর বেলাটা চড়েছে বাইরে। এ বাড়ির এখন কোনও বিপদ নেই সামনে, বরং এদের মঙ্গল হবে। শান্ত, পবিত্র পরিবেশে সেই আসন্ন মঙ্গলের প্রতিশ্রুতি। স্থানলক্ষণ বোঝবার শক্তি দিয়েছিলেন মধুসুন্দরী দেবী। তা এখনও নষ্ট হয়নি।
দেবদর্শন বললেন—ছড়াটার মানে কিছু বুঝলেন ঠাকুরমশাই?
বললাম—নাঃ, এখনও তো কিছু ধরতে পারছি না। দেখি আর একটু চিন্তা করে। তাছাড়া আমিই যে সেই লোক, যে আপনার বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় বলে দেবে, তাই বা জানছেন কী করে?
-না, তা ঠিক নয়, মানে
—আমি সে তোক না হলে আরও দিন-দুই থাকতে পাবো তো?
দেবদর্শন বিস্মিত মুখে বললেন—ওমা, সে কী কথা! নিশ্চয় থাকবেন। অতিথি নারায়ণ, কত সৌভাগ্য থাকলে তবে বাড়িতে অতিথি আসে—
মানুষটি স্বচ্ছ, বুকের ভেতরটা পর্যন্ত দেখা যায়।
জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, এই লোকটি, মানে অমরজীবন—এর বয়েস কত বলে মনে হয়েছিল আপনার? খুব বুড়োমানুষ কি?
—না, একেবারেই নয়। কত আর হবে? এই—পঁয়ত্রিশ কী ছত্রিশ—
একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশই বটে।
পরের দিন সকালে মুখুজ্যেমশাইয়ের সঙ্গে বৈঠকখানায় বসে গল্প করছি, এমন সময় একজন প্রৌঢ় মানুষ ঘরে ঢুকে জীর্ণ ছাতাখানা দরজার কোণে ঠেসিয়ে রেখে বললেন–নমস্কার রাজাবাবু। এ বছর তো আমার খেলা সামনের মাসে। আজ একখানা টিকিট দিয়ে যাই? সোমবার বিলেতের মেলে কাগজপত্র সব পাঠিয়ে দেব। এদিকে তো আর আসা হবে না। আজই দিয়ে যাই?
দেবদর্শন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—বিলেতের ডার্বির টিকিট। পাবো কত সে আমিও জানি, আর এই ভূষণ রায়ও জানে। তবে বছরে একখানা কিনি, অভ্যেস আর কী। দাও হে, একখানাই দাও–