একটু পরে রঘু এসে নতুন সাজা কলকে বসিয়ে দিয়ে গেল। বার দুই আরামের টান দিয়ে দেবদর্শন বললেন—সূক্ষ্ম বিষয়বুদ্ধি না থাকলে কোনও ঐশ্বর্যই চিরস্থায়ী হয় না। জয়দর্শন এবং তাঁর পিতা শ্রম এবং বুদ্ধি দিয়ে যা গড়ে তুলেছিলেন, পরের দু-তিন পুরুষে তা সবই প্রায় গেল। সবচেয়ে বড় কারণ—একতার অভাব। সংসার বড় হতে লাগল, লাগাম কার হাতে থাকবে তা নিয়ে বিরোধ শুরু হল। ফলে অনিবার্যভাবে এতদিনের ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবার টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যেতে লাগল। বর্তমানে এই গ্রাম ছাড়াও কত জায়গায় জয়তলার মুখুজ্যেরা ছড়িয়ে আছে। সন্তুষ্ট কেউই নয়, সকলেরই ধারণা সে তার ন্যায্য প্রাপ্যের চেয়ে কম পেয়েছে। আমি ঝগড়াঝাটি করিনি, কিন্তু বাপ-পিতামহের এই ভদ্রাসন দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছি। টাকা না পাই, স্মৃতি থাক।
চিরদিনই আমার গল্প শুনতে ভাল লাগে। আর ভাল লাগে এইরকম পড়ন্ত বনেদি বাড়ির পরিবেশ। এসব বাড়ির প্রতিটি ইঁটে, কার্নিশে বটগাছের চারায়, বারান্দার বাঁকে বাঁকে পুরনো দিনের গল্প মিশে আছে। কাদের যেন সব ফিসফাস কানাকানি, হঠাৎ আবো অন্ধকারে কে যেন কোথায় হেসে উঠল, মিলিয়ে আসা ধূপের গন্ধ পাক খায় আনাচে কানাচে।
দেবদর্শন আবার বলতে শুরু করলেন—আমাদের পরিবার শেষ বড় ধাক্কা খেল। আমার বাবার আমলে। ঠাকুর্দাকে বাবা দেবতার মত শ্রদ্ধা করতেন। ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর বাবা স্থির করলেন একটা অসাধারণ শ্রাদ্ধের আয়োজন করে সবাইকে দেখাবেন নিজের বাবাকে তিনি কতখানি ভালবাসতেন। খুবই ছেলেমানুষি সন্দেহ নেই, কিন্তু বাবা এটা করলেন সত্যি সত্যি ঠাকুর্দাকে ভালবেসে। তখনকার যুগে বড় বড় ধনী পরিবারে অন্নপ্রাশন বিয়ে শ্রাদ্ধ বা দুর্গোৎসব নিয়ে ভয়ানক রেষারেষি ছিল—কে কতটা জাঁকজমক বা খরচ করল সে ব্যাপারে প্রতিযোগিতা। বাবা কিন্তু এসব সামাজিক দলাদলি আর লোকদেখানো ভড়ং একদম পছন্দ করতেন না। আসলে তিনি এইভাবে ঠাকুর্দার স্বর্গস্থ আত্মাকে দেখাতে চাইলেন তার শ্রদ্ধা কতটা বিস্তৃত আর গভীর ছিল। আপনি পণ্ডিত মানুষ, কতরকম শ্রাদ্ধ হয় নিশ্চয় জানেন। সবচেয়ে অনাড়ম্বর হল তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ, তারপর যোড়শোপচার, তারপর বৃষোৎসর্গ, তারপর দানসাগর। দানসাগরে গিয়েই সবাই থেমে যায়—মানে, ওইপর্যন্ত যারা পৌঁছতে পারে। কিন্তু এর চেয়েও বড়মাপের শ্রাদ্ধ আছে, তা হল—
বললাম—দ্বিজদম্পতি শ্রাদ্ধ।
দেবদর্শন একটু যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন—আপনি জানেন? অবশ্য আপনি তো জানবেনই। দ্বিজদম্পতি শ্রাদ্ধে তিলকাঞ্চন থেকে দানসাগর পর্যন্ত সবই করতে হয়। তারপর আমন্ত্রণ করে আনা এক ব্রাহ্মণ যুবক আর এক কুমারী। ব্রাহ্মণ মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়, ওই মণ্ডপেই। তাদের ভূমিদান করতে হয়, মেয়ের গয়না, ছেলের যাবতীয় দাবির জিনিস দিতে হয়। তাদের ঘরবসত করিয়ে ভবিষ্যতের সমস্ত সংস্থান করে দিতে হয়। বুঝতে পারছেন কাণ্ডখানা? সমস্ত ক্রিয়ায় যা ব্যয় হয়, একজন ধনবান মানুষ সারাজীবনে তা উপার্জন করতে পারে না। আমার তখন খুব ছোটবেলা, বছর পাঁচেক বয়েস হবে। আবছা আবছা মনে করতে পারি দূর দূর গ্রাম থেকে নিমন্ত্রণ পেয়ে আসা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের হাতে দানের জিনিস হিসেবে বাসনপত্র, শালদোশালা আর স্বর্ণ-রৌপ্যখণ্ড তুলে দেওয়া হচ্ছে। দ্বিজদম্পতি হাসিমুখে বসে আছেন আসরে, উপস্থিত লোকজন তাদের সাক্ষাৎ বিষ্ণু আর লক্ষ্মীজ্ঞানে প্রণাম করছে। এই গ্রামেই তাদের বসত করানো হয়েছিল। তাদের দুজনের কেউই আজ আর জীবিত নেই। তবে তাদের সন্তানেরা আছে। দক্ষিণা হিসেবে পাওয়া সেই ভূসম্পত্তির উপস্বত্ব থেকে তাদের ভালভাবেই চলে। যায়। আমাকে তারা দাদা বলে ডাকে। নিকট
বললাম—আপনি ভাগ্যবান। এ জিনিস নিজের চোখে দেখেছেন।
—ঠিকই। শ্রাদ্ধ শেষ করে ভাটপাড়া থেকে আসা পুরোহিত বাবাকে বলেছিলেন—রামরূপ মিশ্রের ক্রিয়াকাণ্ডবারিধি বলে যে বিখ্যাত বই, তাতে দ্বিজদম্পতি। শ্রাদ্ধের উল্লেখ পেয়েছিলাম। পরে বাবার কাছে কাজটা শিখেছি। কিন্তু সে তো পুঁথিগত বিদ্যা। দেখলাম আর নিজের হাতে করলাম আজ প্রথম। বাংলাদেশে এ জিনিস আর কোথাও হয়েছে বলে শুনিনি।
থেমে গিয়ে দেবদর্শন আবার জোরে ডাকলেন—রঘু! এই রঘু!
রঘু তার প্রভুর কখন কী প্রয়োজন সব বুঝতে পারে এবং সেজন্য আগে থেকে প্রস্তুত থাকে। ডাক শোনামাত্র সে এসে কলকে বদলে দিয়ে গেল।
এবার তারানাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল—তোমরা ভাবছ, আবার কী করে পৈতে ধারণ শুরু করলাম, সে গল্প বলতে গিয়ে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছি। তা নয়, জীবনের সব কাহিনীই একটার সঙ্গে আর একটা জোড়া কোনও একটা বলতে শুরু করলে অন্যগুলোয় টান পড়ে। তাছাড়া বকবক করা বয়েস বাড়বার একটা লক্ষণ। আর বকব, না থামব?
সর্বনাশ! তারানাথ বলে কী! এই বকুনির লোভেই তো তার কাছে আসা। বললাম— বলতে থাকুন, বলতে থাকুন-তেমন হলে সারারাত বসে শুনব–
তারানাথ পরিতৃপ্ত মুখে নতুন পাসিং শো ধরাল। যে গল্প বলতে ভালবাসে এবং ভাল গল্প বলে, সে আগ্রহী শ্রোতা পেলে যেমন খুশি হয় তেমন আর কিছুতে নয়। সিগারেটে একটা গভীর টান দিয়ে সে আবার শুরু করল—পৈতে কী করে আবার ধারণ করলাম সে গল্প হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুখুজ্যেবাড়ি থেকে চলে আসার আগে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল, সেটুকু বলে নিই। তোমরা ভাব তারানাথ গল্প বললেই বোধহয় কেবল কষ্ট, দুঃখ আর ভয়ের গল্প বলে। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। আমি জীবনের গল্প বলি, জীবন যেমন বিচিত্র উপলব্ধির মালা দিয়ে গাঁথা, আমার গল্পও তাই। কখনও মেঘ, কখনও বরাদুর।