হেসে বললাম—আপত্তি আর কী, আমি কি বোষ্টম যে মাছ-মাংস খাব না? কিন্তু ওসব করার দরকার নেই, আমি আজ চলে যাব–
অবাক হয়ে রঘু বলল—চলে যাবেন! কেন?
—যেতে তো হবে, তাই না? অতিথি কি চিরদিন থাকে?
মাথা চুলকে রঘু বলল—সে তো ঠিকই, ঠাকুরমশাই। তবে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি জল খান, আমি নায়েবমশাইকে খবর দিচ্ছি—
একটু বাদেই নায়েবমশাই এসে হাজির হলেন। গোলগাল চেহারার মধ্যমাকৃতি মানুষটি। ভারি সজ্জন। হেসে বললেন—ঠাকুরমশাই নাকি আজ চলে যাওয়া স্থির করেছেন? কিন্তু তা তো হবার নয়–
বললাম—সে কী! আমি অতিথি, না বন্দী?
জিভ কেটে নায়েবমশাই বললেন—না না, অমন বলবেন না। বন্দী হতে যাবেন কেন? আসলে আপনি অতিথি হয়ে আছেন শুনে বড়কর্তা আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চেয়েছেন। কাল তো দেখা হয়নি–
—এ বাড়ির বড়কর্তা? জমিদারমশাই?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। খুব ভাল লোক। থেকেই যান আজকের দিনটা–
থেকে গেলাম। এক এক জায়গায় অতিথি হয়ে থাকতে মন্দ লাগে না। মুখুজ্যেদের বাড়িও তাই। বেশ শান্ত আর স্নিগ্ধ পরিবেশ, ভাঙা কার্নিশে পাখি উড়ে এসে বসছে, বাড়ির ভেতর থেকে উঁচু গলায় কথা বলার কোনও আওয়াজ আসছে না। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মচারীরা প্রত্যেকে ভদ্র, কেতাদুরস্ত এবং মিষ্টভাষী। ভৃত্যকে দেখে প্রভুকে চিনতে পারা যায়।
কিছুক্ষণ বাদে রঘু এসে বলল—চলুন ঠাকুরমশাই, বড়কর্তা এসে কাছারির বারান্দায় বসেছেন।
তার সঙ্গে গিয়ে চার-পাঁচ ধাপ টানা লম্বা সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠতেই বাড়ির কর্তাকে দেখতে পেলাম। দীর্ঘদেহী, ফর্সা মানুষ। উজ্জ্বল বড় বড় চোখ। কোঁকড়ানো চুলে মাঝখানে সিঁথি করা। পরনে তাঁতের ধুতি আর হাতকাটা বেনিয়ান। বয়েস বছর পঞ্চাশ কী বাহান্ন হবে। যাকে বলে সুপুরুষ। বারবার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। হেলান দেওয়া চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আলবোলায় তামাক খাচ্ছিলেন, আমাকে দেখে সোজা হয়ে বসে হাতজোড় করে বললেন-নমস্কার, বসুন। কাল একটু অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম, আলাপ করা হয়ে ওঠেনি, তাই নায়েবমশাইকে বললাম—যান, নিয়ে আসুন ওঁকে, একটু গল্প করা যাক। আজ থাকছেন তো?
হেসে বললাম–রাজার হুকুম, মানতেই হবে।
জমিদারবাবুর নাম দেবদর্শন মুখোপাধ্যায়। নামটা কিছু আগে নায়েবমশাইয়ের কাছে জেনেছি। তিনি বললেন—তামাক চলে?
—তা চলে।
–ওরে, কে আছিস! ঠাকুরমশাইকে তামাক দিয়ে যা। চলতি তামাক দিবি না, আমার থেকে দে—
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—একনম্বর গয়ার অম্বুরি, খেয়ে দেখুন দিকি
কেমন লাগে—
যে তামাক এতক্ষণ উনি খাচ্ছিলেন সেটাই যদি একনম্বর গয়ার অম্বুরি হয়, তাহলে জিনিসটা নিঃসন্দেহে ভাল। গন্ধে চারদিক আমোদিত করেছে।
চাকর তামাক দিয়ে গেল। মৌজ করে টানতে শুরু করলাম।
দেবদর্শনবাবু বললেন—রাজার হুকুম শুনলে আজ হাসি পায় বটে, কিন্তু এককালে লোকে আমাদের রাজাই বলত। ভেঙে পড়ছে বটে, তবু বাড়িটা দেখলে হয়ত সেটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন। ঠাকুরদার আমল থেকে পতনের শুরু, আর আজ এই যা দেখছেন।
এসব কথার কোনও উত্তর হয় না। চুপ করে তামাক খেতে লাগলাম।
একটু পরে দেবদর্শনবাবু বললেন—প্রায় দেড়শো বছর আগে আমার পঞ্চম ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ জয়দর্শন মুখোপাধ্যায় এই গ্রামের প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামেই গ্রামের নাম। সে সময়ে আমাদের প্রতিপত্তি ভাবতেও পারবেন না ঠাকুরমশাই। জয়দর্শনের পিতা নবাবী আমলে উড়িষ্যায় কী একটা গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দেওয়ানী করে বিপুল ঐশ্বর্য সংগ্রহ করেছিলেন। নবাবের কাজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি এই গ্রাম এবং কাছাকাছি অনেক ভূসম্পত্তি কেনেন। অনেক অর্থসম্পদ উপার্জন করলেও নবাবসরকারে চাকরি করার সময়ে তিনি অন্তরে অন্তরে দাসত্বের গ্লানি ভালই অনুভব করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ভূসম্পত্তির অধিকারী না হলে সমাজে স্থায়ী মান্যতা লাভ করা যায় না। কিন্তু সম্পত্তি কিনে লোকবসতি গড়ে তোলবার আগেই তার মৃত্যু হয়। সে কাজ দক্ষতার সঙ্গে শেষ করেন জয়দর্শন। সবাই বলত—রাজা জয়দর্শন। প্রজারা তাঁকে ভয়ও যেমন করত, তেমনি ভালও বাসত। শুনেছি তাঁর আমলে জয়তলা এবং আশেপাশে কখনও ডাকাতি হয়নি। হলে ডাকাতদের রেহাই ছিল না। ধূমধাম করে মুখুজ্যেবাড়ির দুর্গোৎসব হত। বোধনের দিন থেকে বিজয়ার রাত্তির পর্যন্ত গ্রামের কারও বাড়িতে উনুনে আঁচ পড়ত না। জমিদারবাড়িতে সবার নেমন্তন্ন।
এইপর্যন্ত বলে মুখুজ্যেমশাই থামলেন। কী একটা মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন-ভাল কথা, আপনার পাঁঠার মাংস চলে তো?
বললাম—খুব চলে। কালই নায়েবমশাইকে বলেছি—আমি মাছ-মাংস সবই খাই। আজ সকালেও রঘু জিজ্ঞেস করছিল
—সাহস করে একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন না তো?
অবাক হয়ে বললাম—ও কী কথা! নিশ্চয় বলবেন—
দেবদর্শনবাবু বললেন—আপনি কি স্বপাক ছাড়া আহার করেন না?
–করি বইকি, কেন করব না? আমার ওসব বাতিক নেই—
–তবে কাল নিজে কষ্ট করে রান্না করতে গেলেন কেন? অবশ্য সে আমাদেরই দোষ, অতিথিশালার সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে সিধে দেওয়া হয়েছে। আপনি নিজে তো আর বলবেন না–আমিও কাল ব্যস্ত থাকায় আর-রঘু! এই রঘু!
রঘু এসে দাঁড়াতে মুখুজ্যেমশাই বললেন—শোনন, ঠাকুরমশাইকে আজ থেকে আর সিধে পাঠাবে না, উনি আমার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে খাবেন। যাও, বাড়ির ভেতরে বলে এসো—আর হ্যাঁ, তামাক বদলে দাও।