লোকটাকে খুব চেনা-চেনা মনে হচ্ছে! কোথায় দেখেছি একে?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল! পাঁচ-সাত বছর আগে সেই চড়ইটিপ গ্রাম! আমার বাল্যবন্ধু। বিরাজমোহনের সর্বনাশ করবার জন্য একজন কাপালিক শ্বেতবগলার পূজোর আয়োজন করেছিল। কাকের বাসার কাঠি দিয়ে, ঘোড়ার চর্বি দিয়ে যজ্ঞ করার নিয়ম। বিরাজের নাম লেখা একটা নিমপাতা যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিলেই একমাসের ভেতর উদ্দিষ্টের মৃত্যু। আমার হস্তক্ষেপে ব্যাপারটা বানচাল হয়ে যায়। বিরাজের নিজের দাদাই সম্পত্তির লোভে ভাইয়ের প্রাণহানির জন্য কাপালিককে নিয়োগ করেছিল। পরে ব্যাপারটা খুব ভালভাবে মিটে যায়, দুই ভাইয়ে আবার মিলন হয়ে যায়। কিন্তু ব্যর্থ-মনস্কাম কাপালিক চলে যাবার সময় আমাকে বলে গিয়েছিল কাজটা ভাল করলে না। একজন সাধক কখনও অন্য সাধকের ক্রিয়ায় বাধা দেয় না। তা নিয়ম নয়। আজ হোক, দশ বছর পরে হোক, এর প্রতিফল তোমাকে পেতেই হবে। তৈরি থেকো—
আমি বলেছিলাম—আপনার সাধনা বা কৌলিক ক্রিয়াকর্মে বাধাদান করার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু আপনি তো সজ্ঞানে একজন নিরীহ মানুষের সর্বনাশ করার। জন্য অভিচার ক্রিয়ার আয়োজন করেছিলেন। এরকম প্রচেষ্টার কথা জানতে পারলে সর্বশক্তি দিয়ে তা নিবারণের ব্যবস্থা করতে বলেছেন আমার গুরু।
চোখে আগুন ফুটিয়ে সে বলল—বেশ, আমাকে মনে রেখো।
মনে রাখিনি, ভুলে গিয়েছিলাম। আজ মনোদর্পণে এতদিন পরে তাকে আবার দেখে চিনতে পারলাম।
একটু পরেই কাপালিকের চেহারা মিলিয়ে গেল সামনে থেকে। যাক, কী ব্যাপার জানতে পেরেছি। আগামী পরশু কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী, ওই দিন একটু আসনে বসে পূজা করব। কাপালিক বুঝতে পারবে কার সঙ্গে সে লাগতে এসেছে।
কিশোরী বলল—কেন, কী ক্রিয়া করবেন আপনি? ও বীজমন্ত্র ছাড়া প্রকরণ বলছি, শুনে রাখো। কালো ছাগল, ঘোড়ার খুড়ের কাছের ললাম, কালো মুরগি আর কাকের চারটে করে পালক আগুনে পুড়িয়ে, তিসির তেলে গুলে বাঁহাতের কড়ে আঙুল দিয়ে কপালে তিলক লাগিয়ে পূজার আসনে বসলে যে আমার ক্ষতি করতে চাইছে তার সব কাজ ব্যর্থ হবে। লোকটা মারা পড়বে না ঠিকই, কিন্তু দেহে ও মনে বিরাট ধাক্কা খাবে।
–বীজমন্ত্রটি কী?
তারানাথ কিশোরীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর বলল—গল্প শোনো, গল্প শোনো—
ঘরে এসে তক্তাপোষে শুলাম। মেঝেতে লণ্ঠনটা কমিয়ে রাখা আছে। নরম, মৃদু আলোয় আবছা আবছা সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। পথ হেঁটে ক্লান্ত ছিলাম, একটু বাদেই ঘুম এসে গেল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না, হঠাৎ চটকা ভেঙে তাকিয়ে দেখি ঘরের ভেতরে নিকষ অন্ধকার। এটা কেমন হল? লণ্ঠনে যথেষ্ট তেল আছে, সে তো আমি নিজেই দেখে নিয়েছি। যাক, নেমে জ্বালিয়ে নিচ্ছি।
কিন্তু ঘরের মধ্যে এমন দমবন্ধ করা ভ্যাপসা ভাব কেন? সবকটা জানালা কে বন্ধ করে দিল? জানালা তো ভোলাই ছিল! এই ধরনের উপদ্রব দূর করার সহজ উপায় আর মন্ত্রগুলো অকস্মাৎ কিছুই মনে আসছে না। আলো জ্বাললে মনের জোর ফিরে পাব—আন্দাজে আন্দাজে মেঝেতে নেমে লণ্ঠন আর দেশলাই খুঁজতে গেলাম, কোথাও খুঁজে পেলাম না। তক্তাপোষ থেকে হাত তিন-চার দূরে দরজার পাশে লণ্ঠনটা ছিল। দরজাটাই বা কোথায়? দেয়ালে হাত দিয়ে সমস্ত ঘরটা একবার পাক দিলাম। জানালা বা দরজা কিছুই হাতে ঠেকলো না!
এ আবার কী! আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে! এই অন্ধকূপে কীভাবে বন্দী হলাম আমি? এই কি তাহলে শেষ?
মনে পড়ল বাবার কথা। বাবা বলতেন-দেখ, চক্কোত্তি বামুনের ছেলে। যেখানে যাও, যা করো, পৈতেটা শরীরে রেখো। ভয় পেলে বা বিপদে পড়লে পৈতে আঙুলে জড়িয়ে গায়ত্রী জপ করতে আরম্ভ করবে। অন্ততঃ প্রাণটা রক্ষা পাবে।
অভ্যাসবশত পৈতে খুঁজতে আরম্ভ করে মনে পড়ল—পৈতে তো সেই কবেই বিরজা হোমের কুণ্ডে বিসর্জন দিয়েছি। হায়! এখন কী হবে?
অন্ধকারের ভেতরেই ঘরের ছাদের কাছ থেকে কী যেন একটা নরম, হাল্কা জিনিস আমার মাথায় পড়ে মেঝের দিকে গড়িয়ে গেল।
প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। তারপর মনে হল টিকটিকি বা ওইরকম কিছু হবে। পা দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়ে পায়ে ঠেকলো দেশলাইটা। ভাল মজা! এতক্ষণ কিছুতেই পেলাম না, এখন আপনা-আপনি ফিরে এল। দেশলাই জ্বালতেই দেখলাম ঘরের জানালা-দরজা সব যথাস্থানে আছে। আর–
আর পায়ের কাছে মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটি সদ্য তৈরি গ্রন্থি দেওয়া পৈতে!
হয়ত গুরু পাঠিয়েছেন আমার বিপদ দেখে। অথবা বাবার আত্মা বুঝতে পেরেছে সন্তানের প্রাণসংশয়, তাই—
যাই হোক, তৎক্ষণাৎ পৈতেটা ধারণ করে গায়ত্রী জপ করতে শুরু করলাম। অবাক হয়ে দেখলাম জানালা দুটোই খোলা ছিল, এখন তা দিয়ে মিগ্ধ, শীতল বাতাস আসছে। ঘরের ভ্যাপসা আর দমবন্ধ ভাবটা আর নেই।
জানি না কৌলিক প্রথায় আঘাত করেছি কিনা, কিন্তু সেই থেকে পৈতেটা আর ছাড়িনি। বরাবর ধারণ করে আছি।
০৬. অতিথিশালার পরিচারক রঘু
পরের দিন সকালে অতিথিশালার পরিচারক রঘু এসে ছোট বেতের ধামায় করে চিড়ে আর নারকেল জলখাবার দিয়ে গেল। বাঃ, বেশ নিয়ম তো এদের। অতিথির স্বাচ্ছন্দ্যের। জন্য সর্বদাই ব্যস্ত। বনেদিয়ানা একেই বলে।
জলখাবার খাচ্ছি, এমনসময় রঘু আবার এসে বলল—ঠাকুরমশাই, আপনি কি আজও নিরামিষ খাবেন? কাল রাত্তিরে হঠাৎ কোনও ব্যবস্থা করে ওঠা যায়নি, যদি আমিষ আহারে আপত্তি না থাকে তাহলে তার ব্যবস্থা দেখি—