বললাম—আপনি ভয় পেলেন কেন? ওই কালো বৃত্তের মানে কী?
—ওর মানে আমার প্রতি কেউ তন্ত্রোক্ত অভিচার ক্রিয়া প্রয়োগ করেছে। কেউ আমার ভয়ঙ্কর ক্ষতি করতে চায়, পারলে প্রাণহানি করতে চায়। কিন্তু কে? কেন সে আমার ক্ষতি চায়? এসব জানবার জন্য ঠিক করলাম জয়তলা পৌঁছে একটু বেশি রাত্তিরে মনোদর্পণে বসব—
কিশোরী বলল—মনোদর্পণ আবার কী?
—তোমরা তো জান আমি চন্দ্রদর্শনে সিদ্ধ। বুড়ো আঙুল দিয়ে কান ও দুই তর্জনী দিয়ে চোখ টিপে ধরে মনোসংযোগ করে একটি মন্ত্র রোজ এক হাজারবার জপ করতে হয়। যেদিন সিদ্ধিলাভ হবে সেদিন দেখতে পাবে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, আর নিচে একটি গাছের তলায় দুজন পরী দাঁড়িয়ে। তুমি যা প্রশ্ন করবে পরীরা তার উত্তর দিয়ে দেবে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তোমার অজানা কিছু থাকবে না। প্রশ্ন করার পরেই পরী, চাঁদ সব মিলিয়ে। গিয়ে সামনেটা বায়োস্কোপের পর্দার মত খালি হয়ে যাবে। তুমি যা জানতে চাও, তা সেই পর্দায় ছবির মত ফুটে উঠবে। একেই বলে মনোদর্পণ।
–বাঃ, এ তো ভাল মজা! এতে তো ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী আর ধনী মানুষ হওয়া যায়! আগামীকাল রেসের মাঠে কোন ঘোড়া জিতবে, কোন শেয়ারের কত দর থাকবে—এই জানলেই তো রাজা! তাছাড়া নিজের বিপদ-আপদ, মেয়ের বিয়ে—সবই তো পরীরা বলে দেবে। আপনি রোজ বসেন না কেন মনোদর্পণে?
তারানাথ হাসল। বলল—খুব বড় আর মূল্যবান প্রশ্ন করেছ। ঠিকই তো, সপ্তাহে একবার করে আসনে বসলেই আমার আর কোনও অভাব থাকবে না। আমার সাংসারিক অবস্থা তো দেখছই, প্রতিদিনের চিন্তা প্রতিদিন করতে হয়। তাহলে রাজা হবার এমন সহজ উপায় গ্রহণ করছি না কেন? না, তা করা যায় না। এইখানেই সাধকের পরীক্ষা। ক্ষমতা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে সংযম অভ্যেস না করলে ক্ষমতা চলে যায়। প্রথম জীবনে শক্তি পাবার দম্ভে এসব অনেক করেছি, পরে সচেতন হয়ে সাবধান হয়ে যাই। লোভ আর প্রকৃত সাধনা একসঙ্গে হয় না।
সন্ধের কিছু পরে পরেই জয়তলা গ্রামে পৌঁছলাম। মুখুজ্যেরা কোনও একসময়ে বর্ধিষ্ণু জমিদার ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তাদের অবস্থা ভাল নয়। বিশাল বাড়ি মেরামতির অভাবে জীর্ণ হয়ে এসেছে। কোথাও দেয়ালের পলস্তারা খসা, কোথাও কার্নিশে বটগাছের চারা। কিন্তু সব মিলিয়ে মানুষজনের আচরণে বনেদিয়ানার ছাপ। বারবাড়িতে দেউড়ির পাশে লম্বা কাছারিঘর, সন্ধের পর এখন আর সেখানে অন্য কর্মচারী কেউ নেই, কেবল সামনে লণ্ঠন নিয়ে প্রৌঢ় নায়েবমশাই বসে কী হিসেব দেখছেন। আমি গিয়ে দাঁড়াতে খেরো থেকে মুখ তুলে বললেন—কে? কী চাই?
নাম বললাম। রাত্তিরটুকু থাকতে চাই তাও জানালাম।
নায়েবমশাই বললেন—অতিথিশালায় ভাল ঘর দিয়ে দিচ্ছি। একটা সিধে দিচ্ছি, তাতে চাল ডাল আলু ঘি লবণ থাকবে। আর আধসের দুধ। সারারাত জ্বলবার মত তেলভরা লণ্ঠন দেওয়া হবে। রঘু–রঘু!
একজন কর্মচারী এসে দাঁড়াল। নায়েবমশাই বললেন—এই একজন অতিথি এসেছেন। এঁকে অতিথিশালায় নিয়ে যাও। পূবের ভাল ঘরটা দেবে।
রঘু আমাকে নিয়ে গিয়ে ঘর খুলে দিল। মাঝারি ঘর। একটা ন্যাড়া তক্তাপোষ আছে, তাতে বিছানাপত্র কিছু পাতা নেই। সে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে, অন্যের ব্যবহার করা বিছানায় বা চাদরে আমার শুতে ভারি অস্বস্তি হয়। রঘু বলল-বারান্দায় কাঠের জ্বালের উনুন আছে ঠাকুরমশাই, আর ওইদিকের কোণের ঘরে চ্যালা করা শুকনো জ্বালানি কাঠ আছে, যত দরকার হয় নিয়ে নেবেন—
সিধে এসে গেল। রান্না করতে করতে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম যে, বিপদ প্রায় আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। বড় মাপের বিপদ। বললাম—কী করে বুঝলেন? কোনও অনুভূতি হল?
তারানাথ বলল—আমার লণ্ঠনের আলো ম্লান হয়ে কমে আসতে লাগল। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো বা তেল ভরে দিতে ভুলে গিয়েছে। কিন্তু লণ্ঠন হাতে তুলে নাড়িয়ে দেখলাম—ভেতরে কলকল করে তেল নড়বার শব্দ হচ্ছে। বনেদি জমিদারবাড়ির কেতাদুরস্ত কর্মচারী, এমন ভুল করবে না। তাহলে?
একটা কেমন ভেজা-ভেজা, সোঁদা গন্ধ আসছে নাকে। চামচিকের নাদি-ভর্তি ঘর বহুদিন বন্ধ থাকার পর খুললে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়। ভাল নয়, একেবারেই ভাল নয়। মনে মনে অপদেবতা তাড়াবার মন্ত্র পাঠ করতে লাগলাম—ওঁ বেতালাশ্চ পিশাচাশ্চ রাক্ষসাশ্চ সরীসৃপাঃ, অপসৰ্পন্তু তে সর্বে গৃহাদস্মাচ্ছিবাজ্ঞয়া।
আস্তে আস্তে আলো আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, গন্ধটাও চলে গেল।
খাওয়া-দাওয়া করে অতিথিশালার বারান্দায় বসে একটা বিড়ি খেলাম। গ্রামাঞ্চলে সাড়ে-আটটা নটার মধ্যেই নিযুতি রাত হয়ে পড়ে। কোথাও মানুষজনের কোনও সাড়া নেই, কেবল দূরে কতগুলো কুকুর ডাকছে। পথ হেঁটে আমিও ক্লান্ত। কিন্তু ঘুমোলে তো চলবে না। এখন দেহবন্ধন করে আসনে বসে মনোদর্পণে দেখতে হবে কে আমার ক্ষতি করতে চায়—এবং কেন?
চন্দ্ৰদৰ্শন আমার এমন আয়ত্তে এসে গিয়েছিল যে, চোখের সামনে পূর্ণচন্দ্র আর দুই পরীদের আনতে দশ মিনিটও লাগল না। মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রশ্ন করতেই সামনে পরী, চাদ সব মুছে গিয়ে সাদা দেয়ালের মত শূন্যতা ফুটে উঠল। চৌকো সেই পর্দা থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে একটা ভয়াবহ হিংস্র মুখ। মাঝখানে সিঁথি করা লম্বা কোঁকড়ানো চুল, কপালে তেল-সিঁদুরের ত্রিপুণ্ড্রক, গলায় রুদ্রাক্ষ আর হাড়ের মালা। খুব নিম্নমার্গের সাধক-মুখে সাধনার জ্যোতি নেই, রয়েছে ক্রোধ আর নিবিড় হিংসা। এদের উপকার করার ক্ষমতা নেই, কিন্তু অপকার করার ক্ষমতা অসীম।