—খুব সামান্য। সাধনার জন্য যত ব্যগ্রই হওয়া যাক না কেন, ওটুকু মানুষী দুর্বলতা থেকেই যায়। সমাজ ও সংসারের প্রতি স্বাভাবিক যে টান। শ্রাদ্ধের চেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল পৈতেটা ত্যাগ করতে। সেই সময়টায় বুঝেছিলাম আজন্মলালিত বিশ্বাস ও সংস্কার কতখানি গভীরে শেকড় গেড়ে থাকে।
—পৈতে কেন ত্যাগ করতে হয়?
—বিরজা হোমের পরে তুমি আর কারও সন্তান নও, তোমার কোনও সামাজিক সম্প্রদায় নেই। তুমি ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় শূদ্র কিছুই নও। তুমি কেবল একজন সাধক। পৈতে থাকলে বর্ণশ্রেষ্ঠ হিসেবে তোমার অহংবোধ জন্মায়। সাধনার ক্ষেত্রে তা অমার্জনীয়।
বললাম—এখন তো আপনি পৈতে ধারণ করে আছেন। কেন?
তারানাথ হেসে বলল—আবার গৃহাশ্রমে ফিরে এসেছি, সেও তো বেশ অনেক বছর হয়ে গেল। মনে মনে গুরুর কাছে ক্ষমা চেয়ে পিছিয়ে এলাম। দেখলাম ভেতরে ভেতরে আমার ভোগবাসনা আর সংসার করার কামনা পুরোপুরি রয়ে গিয়েছে। দুই নৌকোয় পা দিয়ে চলা যায় না। দেখলাম ফিরে আসাই ভাল–
—কবে আবার পৈতে নিলেন?
—সেটা বেশ একটা আশ্চর্য ঘটনা। শুনবে?
বলে কী তারানাথ জ্যোতিষী! গল্প শোনার লোভেই তো ছুটির দিনে তার কাছে এসে বসে থাকি। বললাম—অবশ্যই শুনবো। বলুন—
একটা পাসিং শো ধরিয়ে দেশলাইয়ের কাঠিটা ছাইদানি হিসেবে রাখা নারকেলের মালায় গুঁজে দিতে দিতে তারানাথ বলল—এতসব অদ্ভুত ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে যে, ভাবলে আমার নিজেরই অবাক লাগে। আর তোমরা তো নিশ্চয় ভাবো লোকটা নির্বিকার মুখে মিথ্যে গল্প বানিয়ে বলে। তোমাদের দোষ দেওয়া যায় না, এসব কাণ্ড বিশ্বাস করা প্রকৃতপক্ষেই কঠিন।
তারানাথ খুব একটা বাজে কথা বলে নি। অদ্ভুত গল্পের নেশায় তার কাছে ছুটে আসি, যতক্ষণ সে গল্প বলে ততক্ষণ মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনেও যাই, কোনও বিরুদ্ধ যুক্তি মনে উঁকি দেয় না। কিন্তু তার সান্নিধ্যের প্রবলতা থেকে মুক্তি পেয়ে গল্পের শেষে মন্টু লেনের বাইরে এসে কলকাতার কঠিন ফুটপাথে পা দিলেই বিশ্বাস একটু একটু করে ক্ষইতে শুরু করে। মুগ্ধতা থাকে, বিশ্বাসটা থাকে না। তবু পরের সপ্তাহে আবার যাই। গল্পের এমনই নেশা।
তারানাথ বলল—এ ঘটনা আমার প্রথম জীবনের। আজ থেকে প্রায় তিরিশ কি পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা। দীক্ষা নিয়েছি তা আট-দশ বছর হয়ে গেল, কিন্তু মনের ভেতর কোনও প্রসন্নতা অনুভব করি না। গুরুর প্রদর্শিত পথে সাধনা করবার চেষ্টা করি, আর হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়াই।
এমনি ঘুরতে ঘুরতে একদিন দুপুরের কিছু পরে ক্লান্ত হয়ে একটা নদীর ধারে কঁকড়া এক বটগাছের ছায়ায় আশ্রয় নিলাম। জায়গাটা ভারি শান্তিপূর্ণ, নদী বয়ে যাচ্ছে সামনে, মাথার ওপরে নানা ধরনের পাখির বিচিত্র ডাক। একটু বিশ্রাম করে নদীতে নেমে হাতমুখ ধুয়ে জল খেয়ে ঠাণ্ডা হলাম। এখনও বেশ রোদ, কিছুক্ষণ গাছের ছায়ায় শুয়ে থেকে তারপর পথ হাঁটলেই হবে। নদী থেকে উঠে এসে গাছের একটা শেকড়ে মাথা দিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়লাম। ভবঘুরে জীবনের এই একটা সুন্দর দিক—কোনও দায়দায়িত্ব কিচ্ছু নেই, মুক্ত আনন্দে ঘুরে বেড়াও, ইচ্ছে হলে কোথাও দু-দিন থাকো, ইচ্ছে না হলে আবার বেরিয়ে পড়ো পথে। ভারি আনন্দের জীবন, চমৎকার জীবন–
বললাম—তাহলে আর সংসারের এই বন্ধনের মধ্যে ফিরলেন কেন?
একটু চুপ করে থেকে তারানাথ বলল—আগেই তো বলেছি সত্যিকারের বড়মাপের সাধক হওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না। জগৎব্যাপারে বিশাল মুক্তির মধ্যে চিরতরে নিজেকে যুক্ত করতে গেলে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হয়। নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য। তবু বলি, জীবনের ওই কটা বছর বড় আনন্দে, বড় শান্তিতে কাটিয়েছি।
ঠাণ্ডা ছায়ায় শুয়ে ঝিরঝিরে বাতাসে বোধহয় একটু ঘুম এসে গিয়েছিল। চটকা ভেঙে যেতে দেখলাম বেলা গড়িয়ে গিয়েছে, সূর্যাস্ত হতে আর খুব দেরি নেই। পথে শুনেছি আরও মাইল চারেক গেলে পড়বে জয়তলা গ্রাম। সেখানকার মুখুজ্যে জমিদাররা যাত্রীদের জন্য অতিথিশালা করে রেখেছেন। সেখানেই রাত্তিরটা থাকবো। এখনই হাঁটতে শুরু করা দরকার, কারণ চার মাইল যেতে কম সময় লাগবে না।
নদী বাঁদিকে রেখে চলেছি, সন্ধের পরে পরেই জয়তলা পৌঁছে যাব। হঠাৎই কেন যেন বাঁদিকে তাকালাম। তাকানোমাত্র এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল।
সূর্য দিগন্তরেখা প্রায় ছুঁয়েছে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে ডুবে যাবে। সেই অস্তোন্মুখ রক্তবর্ণ সূর্যের গোলক ঘিরে একটা ঘোর কালো বৃত্ত! গতকালও এখান থেকে বারোতেরো মাইল দূরে একটা গ্রামের বাইরের মাঠে বসে সূর্যাস্ত দেখেছি। কই, এমন কিছু চোখে পড়েনি তো! কালো মেঘ বা বাতাসে হঠাৎ জমে ওঠা কালোরঙের ধুলো বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ একেবারে অন্যরকম। আকাশের গায়ে যেন একটা মোটা, চওড়া কালো অন্ধকারের গণ্ডী। অমঙ্গলের অগ্রদূত।
কিশোরী জিজ্ঞাসা করল-অমঙ্গলের অগ্রদূত বলছেন কেন? জিনিসটার তো প্রাকৃতিক ব্যাখ্যাও থাকতে পারে–
-না, তা পারে না। আসলে তোমরা ব্যাপারটা দেখ নি, দেখলে বুঝতে পারতে। দেখতে পেতে না অবশ্য, ওটা কেবল আমার কাছেই দৃশ্যমান হয়েছিল। সেটাও একটা বড় প্রমাণ যে, এর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হয় না–
—আর কেউ দেখতে পায়নি বুঝলেন কী করে?
–ওসব গ্রাম জায়গা, কেউ অমন অদ্ভুত কিছু দেখতে পেলে মুহূর্তে তা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ত। জয়তলা গ্রামের দিকে হাঁটছি, চাষীরা দিনের কাজ সেরে বাড়ির দিকে ফিরছে, রাখাল ছেলেরা গরুর পাল তাড়িয়ে গ্রামে যাচ্ছে। আমি ছাড়া তারা কেউই কিছু দেখতে পাচ্ছে না।