তারানাথ একটু থামল।
জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু কী?
আমরা সাধারণ মানুষ রে ভাই, প্রেমিকা হিসেবে দেবীকে সামলানো কি আমাদের পোষায়? মানুষ-বৌ নিয়েই জেরবার হতে হয়। কিন্তু এটা ঠিক, সাধকের জীবনকে দেবী স্বর্গীয় প্রেমসুধায় পূর্ণ করে দেন—
কিশোরী বলল—স্বর্গীয় বলছেন, এঁরা কি স্বর্গের দেবী?
–না। একেবারেই না। মহাডামরের এক বিভাগ হচ্ছে ভূতডামর। ভূতডামরে এইসব জীবেদের উল্লেখ আছে। এরা মানুষও নয়, আবার সাধারণ অর্থে প্রেতও নয়। দেবতা তো নয়ই। ভূত বলতে লোকে বোঝে পরলোকের অধিবাসী, মানুষ মরে যেখানে যায়। ভূতডামরে যাদের উল্লেখ রয়েছে, তারা মানুষ এবং তথাকথিত ভূতপ্রেতের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত জগতের বাসিন্দা। আজন্মকাল লালিত আমাদের শুভ ও অশুভের বোধ, মঙ্গলের ধারণা, ন্যায়-অন্যায়, পবিত্রতা–কিছুই সেখানে খাটে না। আজ যে দেবীর মহিমা নিয়ে আমাকে সেবা ও প্রেমে ধন্য করছে, মন্ত্র ও সাধনায় সামান্য ত্রুটি হলে পিশাচীর মত সে আমাকে ধ্বংস করবে। এদের প্রেমও চরম, প্রতিহিংসাও চরম।
বললাম—প্রতিহিংসা কীসের? সাধক তো কোনো অন্যায় করেনি–
–করেছে বইকি। তোমাকে যদি কেউ তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করে খাটিয়ে নেয় তাহলে কি তোমার খুব ভাল লাগবে? তেমনি বিপুল ক্ষমতাশালী ডামরীদের তুমি মন্ত্রের বাঁধনে আটকে তোমার ইচ্ছেমত কাজ করাচ্ছ, এতে কি তারা খুশি হচ্ছে? তা নয়। কিন্তু অসহায়ের মত তারা তোমার ক্রীতদাস হয়ে আছে। আত্মরক্ষার বর্মে এতটুকু ছিদ্র পেলে তারা তোমাকে নির্মমভাবে হত্যা করবে। আমি নিজে দেখেছি—
তারানাথ যেন একটু শিউরে উঠে থেমে গেল।
কিশোরী জিজ্ঞেস করল-কী দেখেছেন?
—অসাবধানী সাধকের মর্মান্তিক পরিণতি। মাথাটা মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল—
বিষয়টি মুখরোচক নয়। আগ্রহ হলেও আর কোনো প্রশ্ন করলাম না।
তারানাথ বলল-বাড়ির লোক খবর পেয়ে আমাকে গিয়ে ধরে আনে। তখন আমার পাগলের মত দশা। কত মাস চুল-দাড়ি কাটিনি, বড় বড় নখ, শতছিন্ন জামাকাপড়, গায়ে ময়লা। বাড়ি ফিরে আসবার আগের রাত্তিরে শেষবারের মত দেবী আমাকে দেখা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—কিছু শক্তি তোমাকে দিলাম। যদি বুঝে ব্যবহার করতে পার তাহলে জীবনে অন্তত ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না। আমার সঙ্গে আর দেখা না হওয়াই সম্ভব, যদি না–
কীভাবে দেখা হতে পারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। দেবী উত্তর দেননি।
যাই হোক, আমার সাংসারিক অবস্থা তো দেখছ। কিন্তু দেবীর আশীর্বাদে একরকম করে চয়ে যায়। বড়লোক হতে পারিনি, কিন্তু ভিক্ষেও করতে হয়নি।
কিশোরী বলল–আমাদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার প্রথমদিকে আপনি বীরভূমের শ্মশানবাসিনী মাতু পাগলীর কাহিনী বলেছিলেন। তার সঙ্গেও পরে আর দেখা হয়নি?
তারানাথ বলল—না। তবে আমার মনে হয় মাতু পাগলী, তন্ত্রে উল্লিখিত ডামরী, মধুসুন্দরী দেবী—এঁরা সব আসলে একই শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ। মাতু পাগলী ছেড়া কাপড় পরে গ্রামের শ্মশানে বসে থাকত বটে, কিন্তু সে বিশাল শক্তির অধিকারিণী ছিল। এখন আমার মনে হয় সে মানুষ ছিল না। আমার খুব সৌভাগ্য তাই তার দেখা পেয়েছিলাম।
বললাম—মানুষ ছিল না বলছেন, তাহলে সাধারণ মানুষের মত হাটে-মাঠে পড়ে থাকত কেন?
–মাতু পাগলী যে পর্যায়ে উঠেছিল, সেখানে পৌঁছলে পার্থিব সুখৈশ্বর্য তুচ্ছ হয়ে যায়। শ্মশানে থাকলেও যা, রাজপ্রাসাদে থাকলেও তাই। সেসময় একটা গুজব শুনেছিলাম লোকের মুখে, তখন বিশ্বাস করিনি। শুনেছিলাম মাতু পাগলী নাকি আহার্য বা পানীয় গ্রহণ করে না। পরে ভেবে দেখেছি, সত্যিই তো, এক একদিন সকাল থেকে গভীর রাত্তির পর্যন্ত তার সঙ্গে কাটিয়েছি, কখনও তার সামান্য জলও খেতে দেখিনি। ছায়াটা অবশ্য খেয়াল করিনি, তখন জানতামও না–
কিশোরী বলল—ছায়া খেয়াল করা কী রকম?
—গ্রামাঞ্চলে প্রবাদ আছে জানো তো, প্রেত-পিশাচের নাকি ছায়া পড়ে না। কথাটা আংশিক সত্য, পুরোটা নয়। তাদেরও ছায়া পড়ে ঠিকই, কিন্তু গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ছায়া পড়ে না। একটু জলমেশানো ভেজাল ছায়া পড়ে। অভিজ্ঞ সাধক দেখলে বুঝতে পারে।
ভেজাল ছায়া! কতরকম অদ্ভুত কথাই যে শুনলাম তারানাথের কাছে!
তারানাথ অনেকসময় মানুষের মুখ দেখে নির্ভুলভাবে মনের কথা আন্দাজ করে ফেলে। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল—বিশ্বাস করা কঠিন, না? ভাবছ, এ বুড়ো কীসব আবোলতাবোল বকে আসর জমাবার চেষ্টা করে। ব্যাপার অত সোজা নয়। দেবীর দয়ায় আর গুরুর আশীর্বাদে কিছু গুণ লাভ করেছিলাম, এসব তারই প্রকাশ। বলেছি বোধহয় তোমাদের-আমার তন্ত্ৰদীক্ষা হয়েছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়ে। গলায় পদ্মবীজের মালা পরে গুরু যখন বিরজা হোমের পূর্ণাহুতি দিলেন, তখন আকাশে গ্রহণগ্রস্ত সূর্য তাম্রাভ চাকার মত বিবর্ণ আর স্নান দেখাচ্ছে। গুরুই বলেছিলেন—খুব শুভযোগে তোমার দীক্ষা হল। অনেক ক্ষমতা লাভ করবে তুমি–
বললাম-বিরজা হোম কী?
—সংসার ত্যাগ করে তবে সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশ করতে হয়। দীক্ষার পরমুহূর্ত থেকে সাধকের আর কোনও সামাজিক পরিচয় থাকে না। এমন কী, বাবা-মায়ের শ্রাদ্ধ করার অধিকার থেকেও সে বিচ্যুত হয়। দীক্ষার সময় যে বিশেষ যজ্ঞের মাধ্যমে নিজের শ্রাদ্ধ করতে হয়, তারই নাম বিরজা হোম।
বললাম—নিজের শ্রাদ্ধ করার সময় আপনার মন খারাপ হয়নি?