অমর খুব কম খায়। মাত্র চারখানি পুরী সে খেল, বাকি সবগুলো খেতে হল আমাকে। অবশ্য পথ হেঁটে আমার খিদে পেয়ে গিয়েছিল। কলসী কাত করে কানায় হাত দিয়ে জল খেলাম। তারপর মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে অমর বলল—এসো, এইবারে গল্প করি।
অন্ধকারের ভেতর থেকে তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে লাগল। কত গল্প সে শোনাল সারারাত ধরে। তেমন কথা আমি কারও কাছে কখনও শুনিনি। সাধারণ ডাল-ভাত খাওয়া জীবনের কথা নয়, যেন অচেনা ভাষায় অচেনা সুরে অদ্ভুত গান শোনাচ্ছে কেউ। আকাশ আর নক্ষত্রের গল্প, সমুদ্রের ঢেউয়ের গল্প, আগুন-বাতাস-পাহাড়-মাটির গল্প। সে। আমি তোমাদের ভাষা দিয়ে ঠিক বোঝাতে পারব না। সৃষ্টির আদিম গল্প সে, আমাদের প্রত্যেকদিনের জীবনে তার কোনও প্রতিচ্ছবি হয় না। সেই রাতের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কথা বলতে বলতেই অমরজীবন হঠাৎ বলল–তোমার ছোট ঠাকুর্দা গৃহত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন, না? উনি এখনো বেঁচে আছেন।
আশ্চর্য তো! কী করে সে কথা জানলো এই লোকটা? কিন্তু তখন আমার এত ঘুম পেয়েছে যে, যথেষ্ট অবাকও হতে পারলাম না।
তখন রাত বোধহয় তিনটে পেরিয়ে গিয়েছে, অমর বলল—না, আর কথা না। এবার তুমি ঘুমোও। বাড়ি চলে যেও কিন্তু। কালকেই। তোমার ভালর জন্যই বলছি।
আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে। বললাম—আপনিও চলুন না আমার সঙ্গে। যাবেন?
—না, এবার না। এবার থাক। তবে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে আমার।
আমার কানে যেন কে নিদুলির মন্ত্র পড়ে দিয়েছে। আর তাকাতেই পারছি না। ঘুম-ঘুম।
যখন ঘুম ভাঙল তখন রোদুর উঠে গিয়েছে। গতকাল রাত্তিরের মেঘ-বৃষ্টির চিহ্ন নেই কোথাও, ঝকঝক করছে দিনের আলো।
পাশে অমরজীবন নেই। তার ঝোলাঝুলিসহ কখন সে চলে গিয়েছে কে জানে।
কাল সন্ধেবেলা দেখা সেই পুরোহিত এসে মন্দিরের দরজা খুলে সকালের পুজোর উদ্যোগ করছে। আমার দিকে আড়ে আড়ে তাকাল কবার। জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, এখানে যে আর একজন পরশু থেকে ছিলেন, তিনি চলে গিয়েছেন?
সে বলল—কে ছিলেন?
—একজন যাত্রী। আমার আগে থেকেই তো ছিলেন—
–দেখিনি। খেয়াল করিনি। অমন কত লোক যাচ্ছে আসছে—
লোকটি শুধু নীরস নয়—নিরুৎসুক, নিরুদ্বেগ এবং সম্পূর্ণ নিরুত্তাপ।
যাই হোক, অমরজীবন লোকটিকে আমার খুবই অদ্ভুত লেগেছিল, তার কথা অমান্য করতে মন চাইল না। সেদিনই রওনা হলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছনোর পর প্রতিবারের মতই প্রথমে বাবার বকাঝকা, তারপরে মায়ের কান্নাকাটি, এবং তারও পরে আত্মীয়স্বজনের আবেগের বন্যা সহ্য করতে হ’ল। দুপুরে খেতে বসে বাবা বললেন—গত পরশুদিনই সরসী চাটুজ্জের আড্ডায় তোমার কথা হচ্ছিল। আমার যে একটা এমন বাড়িপালানো হাড়জ্বালানো ছেলে হবে সে কথা অনেক আগেই একজন বলে দিয়েছিল—
বললাম–কে? কোনও জ্যোতিষী?
—না। এমনিই একজন পথিক। আমার ছোটবেলায় একদিনের জন্য আমাদের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল। তার নাম অমর, অমরজীবন। সেই গল্পই হচ্ছিল সরসী চাটুজ্জের বাড়ি
চমকে উঠে বললাম—অমর! অমরজীবন!
বাবা বললেন—হ্যা! চমকে উঠলে কেন?
—না, কিছু না। গল্পটা বরং বলুন, শুনি—
খেয়ে উঠে গড়গড়ায় তামাক খেতে খেতে বাবা বলতে শুরু করলেন।
নিজের বাবার কাহিনী লেখকের বর্ণনার ভঙ্গিতে বলে গেল তারানাথ। তারপর থেমে একটু দম নিয়ে বলল—এই ব্যাপারটার সবচেয়ে বিচিত্র দিক কোনটা জানো? যে লোককে চল্লিশ বছর আগে বাবা পঁয়তাল্লিশ বছরের দেখেছিলেন, তাকে এতকাল পরে আমিও সেই বয়েসে দেখলাম কী করে?
ছোট ঠাকুর্দার খবরটা বাবাকে জানাবো ভেবেছিলাম, দেখলাম অমরজীবন মারফৎ সেটা তিনি আগেই জানেন।
পরদিন বুঝলাম কেন অমরজীবন বাড়ি চলে আসতে বলেছিল। পরদিন থেকে আমার এল প্রবল জ্বর। প্রায় দেড়মাস ভুগে সেরে উঠলাম। পথে থাকলে প্রাণসংশয় হত সন্দেহ নেই।
০৫. পাসিং শো ধরাবার জন্য
পাসিং শো ধরাবার জন্য তারানাথ থামল।
বাইরে সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। মন্টু লেনের একটু ভেতরদিকে তারানাথের বাড়ি, এখান থেকে বড়রাস্তার কোলাহল আর গাড়িঘোড়ার শব্দ খুব আবছাভাবে শোনা যায়। কলকাতার পুরনো গৃহস্থপাড়ায় দিনাবসানের একটা আলাদা মেজাজ আছে, কলকাতার বনেদি বাসিন্দারা সেটা টের পায়। তারানাথের বাড়িতে বসে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারা যায়।
তারানাথ বলল-আর একটু চা বলি, কি বল?
কিশোরী বলল বেশ তো, বলুন। ততক্ষণে আমি বরং গলির মোড় থেকে গরম তেলেভাজা নিয়ে আসি। তেলেভাজা আর চা একসঙ্গে না হলে আবার আড্ডা কী?
–আরে না না, কেন আবার ওসব ঝামেলা—
তারানাথের আপত্তিতে কর্ণপাত না করে কিশোরী বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই সে ফিরে এল হাতে বেশ বড় মাপের এক শালপাতার চাঙাড়ি নিয়ে।
-কী হে! এতসব কী এনেছ?
তারানাথের সামনে চাঙাড়ি নামিয়ে কিশোরী বলল—একেবারে সদ্যভাজা বেগুনী, ঝালবড়া আর মোচার চপ। কিছু আমাদের জন্য রেখে বাকি ভেতরে পাঠিয়ে দিন
চারি চা নিয়ে এল। আমরা বেগুনীতে কামড় দিয়ে গল্পের আশায় উৎসুকভাবে তারানাথের দিকে তাকালাম। হাত দেখা বা কোষ্ঠীবিচার জানি না, কাজেই তারানাথ কত বড় জ্যোতিষী বোঝবার ক্ষমতা আমাদের নেই। যে গল্প সে আমাদের শোনায় তার সত্যাসত্য বিচারও দুঃসাধ্য, কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে—গল্প বলে মানুষকে মুগ্ধ করে রাখার ক্ষমতায় তারানাথ অদ্বিতীয়। বাড়ির বাইরে জ্যোতিষ কার্যালয়ের সাইনবোের্ডটা বিবর্ণ হয়ে ঝুলে পড়েছে, পুরনো কয়েকজন বাঁধা খদ্দের ছাড়া আজকাল ভাগ্যগণনায় আগ্রহী নতুন লোক বড় একটা ভিড় করে না। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে তারানাথের ব্যবসায় ভয়ানক মন্দা চলেছে। তাতে তারানাথের বিশেষ উদ্বিগ্নতা কিছু নেই, আর আমাদের তো ভালই হয়েছে। একদিন তারানাথ নিজেই বলল-বরাকর নদীর ধারে বালির চড়ায় পোড়া শোলমাছের নৈবেদ্য দিয়ে মধুসুন্দরী দেবীকে অর্ঘ্য দিয়েছিলাম, সে গল্প তত তোমাদের বলেছি। সেই রাত্তিরেই নদীর ধারের শালবনে স্নান অপার্থিব জ্যোৎস্নায় দেবী আবির্ভূত হলেন। সেই অলৌকিক সৌন্দর্য মানবীর হয় না, সেই ভালবাসা পৃথিবীর নারীর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রায় এক বছর ধরে বরাকর নদীতীরের শালবন আমার তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠল। রোজ রাত্তিরে দেবী দেখা দিতেন। আমি চরিত্রের দিক দিয়ে শুকদেব নই, কামনা-বাসনাহীন ঋষিও নই। কাজেই মহাডামরতন্ত্রে মাতৃরূপে বা কন্যারূপে যে দেবীদের পাওয়া যেতে পারে তাদের জন্য সাধনা করিনি। গুরু বলেছিলেন কন্যারূপে কনকবতী দেবীর আরাধনা করতে। আমার সে পরামর্শ মনঃপূত হয়নি। মধুসুন্দরী দেবীকে প্রেমিকা হিসেবে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু–