বললাম—আপনার নামটা তো জানা হ’ল না—
লোকটি চুপ করে থেকে বলল—আমার নাম অমর। অমরজীবন।
–বাড়ি কোথায়? এই জেলাতেই বুঝি?
অমরজীবন কোনও উত্তর দিল না। বুঝলাম নিজের কথা বলতে সে আদৌ আগ্রহী নয়। অন্য প্রসঙ্গে যাবার জন্য বললাম—আশ্রয় তো যাহোক পাওয়া গেল, কিন্তু খাওয়াটা বোধহয় জুটবে না
–না না, তা কেন? ঝড়টা থামুক, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে এখন–
—তা কী করে হবে? কাছাকাছি কোনো দোকানপাট দেখছি না। গ্রামে হয়ত আছে, কিন্তু তারা কি এই ঝড়বাদলে দোকান খুলে রাখবে? মনে হয় না।
অমর বলল-রাত্তিরে কী খাও তুমি? ভাত না রুটি?
বললাম–আমি ঠিক সন্ন্যাসী না হলেও পথে ঘুরছি অনেকদিন। সবই অভ্যেস আছে।
–বেশ, বেশ। ভাল। খাবার এসে যাবে।
অন্ধকারে অমরের মুখচোখ ভাল দেখতে পাচ্ছি না। লোকটা পাগল নয় তো? কোথায় খাবার?
অমর বলল—কালকেও আমি এখানে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম আজ তুমি আসবে, তাই একটা দিন বেশি থেকে গেলাম। এমনিতে আমি দু-রাত্তির কোথাও থাকি না–
হ্যাঁ, নিশ্চয় পাগল। গতকাল রাত্তিরে স্বপ্ন দেখেছে আজ আমি আসব! বদ্ধ পাগল ছাড়া কী?
বললাম—আপনি জানতেন আমি এখানে আসব?
-হ্যাঁ।
–স্বপ্নে দেখেছেন?
-হ্যাঁ। স্বপ্ন দেখার প্রয়োজন হলে আমাকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে সেখানে থাকতে হয়।
বেচারী! এমনিতে বেশ ভাল লোকটা, ভদ্র আর মিষ্টি কথাবার্তা। দোষের মধ্যে পাগল।
এরপরেই অমরজীবন হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি বাড়ি চলে যাও।
আমি প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি সে কী বলছে। বললাম—তার মানে? বাড়ি যাব কেন?
—কিছু না। ভবঘুরে জীবন ত্যাগ করে সংসারে ফিরে যেতে বলছি না। সে যখন সময় হবে যাবে। তোমার নিজের ভালর জন্য বলছি, কয়েকটা দিনের জন্য বাড়ি যাও—
আচ্ছা বিপদ তো! বললাম—কিন্তু কেন?
—মনে করো না আমি তোমার বন্ধু, আমি অনুরোধ করছি তাই যাচ্ছ।
তার কথাগুলো একটু কেমন কেমন। কিন্তু গলার স্বরে একটা ব্যক্তিত্বপূর্ণ দৃঢ়তা আছে। তার কথা মনোমত না হলেও অকস্মাৎ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তখনকার মত তাকে শান্ত করার জন্য বললাম–আচ্ছা, আচ্ছা। সে দেখা যাবে এখন। বিড়ি চলে?
সে হাসল। বলল—সব চলে। আছে? দাও–
তাকে দিয়ে নিজে একটা বিড়ি নিলাম। বাতাসের দাপটে চার-পাঁচটা কাঠি নষ্ট করেও ধরাতে পারছিলাম না। অমর হাত বাড়িতে বলল—আমাকে দাও দেখি–
তারপর দেশলাইটা হাতে নিয়ে অদৃশ্য কার দিকে যেন ধমক লাগাল—আরে একটু থাম্ তো রে বাপু! একটা বিড়ি ধরাতে কি একটা আস্ত দেশলাই খরচ করব নাকি?
কাকতালীয় কিনা জানি না, হাওয়ার ঝাপটা সামান্য কয়েক মুহূর্তের জন্য কমে গেল। ঝড় চলতে চলতে এরকম অবশ্য হয়ই, তবু মনে রেখাপাত করল জিনিসটা। দেশলাই ফেরৎ দিয়ে অমর বলল—সবকিছুর ব্যাখ্যা চাইতে নেই। ব্যাখ্যা হয়ও না। তার চেয়ে সরল বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করা ভাল। আদেশ পেলে পালন করা ভাল।
—আদেশ কে পাঠায়?
বিড়িতে গোটাদুই টান দিয়ে অমর বলল—তা জানলে তো সব সমস্যাই মিটে যেত।
—আপনার কাছে আদেশ পৌঁছয় কেন? আপনি কে?
উত্তরে অমর বলল—বিড়িটা ভাল। খুব নরমও না, খুব কড়াও না। বেশ মিঠেকড়া ধরনের। কোত্থেকে কিনেছ? খাওয়ার পরে আর একটা দিও তো–
ঝড় থেমে গিয়ে নামল বৃষ্টি। চলল বেশ কিছুক্ষণ। দিকদিগন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মন্দিরের পেছনে কোথা থেকে ব্যাঙ ডাকতে লাগল। বৃষ্টি যখন থামল, তখন পাড়াগাঁর হিসেবে বেশ রাত। দেখি পথে জমা জলে ছপ ছপ করে কে একজন হেঁটে এসে নাটমন্দিরে উঠল। সামনে ঝুঁকে অন্ধকারে ঠাহর করার চেষ্টা করে ডাকল—ঠাকুরমশাই! ও ঠাকুরমশাই–
অমর বলল–এই যে, আমি এখানে। দাও–
কাছে এলে দেখলাম লোকটির হাতে একটা বড় শালপাতার ঠোঙা। সে ঠোঙাটা অমরের হাতে দিতে দিতে বলল—আর এক মূর্তি এয়েচে দেখচি। তা হয়ে যাবে’খন দুজনের। দাঁড়াও, খাবার জল দিয়ে যাই। নতুন লোক, জল আনতে গেলে পুকুরঘাটে আছাড় খাবে।
বোধহয় পথিকদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মন্দিরের চাতালে রাখা একটা মাটির কলসী নিয়ে লোকটি অন্ধকারে কোথায় চলে গেল। অমর বলল—মন্দিরের পেছনেই একটা পুকুর আছে, সেখানে গেল জল আনতে। ভাল, পরিষ্কার জল—
তারপর আমার মুখের দিকে তাকিলে বলল-খাবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলেছিলাম আর খাবার এসে গেল—এর ভেতর কিন্তু অলৌকিক কিছু নেই। এই লোকটির একটা ময়রার দোকান আছে গ্রামে, গতকালও আমাকে খাবার দিয়ে গিয়েছিল। অতিথিসেবা করতে ভালবাসে। পয়সা দিতে চেয়েছিলাম—নেয়নি। আজকের খাবারও দিতে বলা ছিল। যা খাবার দেয় তা আমি একা খেতে পারি না, আজও দুজনের হয়ে যাবে এখন। দেখি কী দিয়েছে–
উঠে গিয়ে যেখানে সে শুয়েছিল সেখান থেকে একটা কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে এল অমর। তার ভেতর থেকে একটা মোমবাতি বের করে বলল—দেখি, দেশলাইটা আর একবার দাও–
শালপাতার ঠোঙা খুলে দেখা গেল ভেতরে গোটা পনেরো বড় মাপের পুরী, আলুর তরকারী, আর অনেকখানি মোহনভোগ। দেশী ঘি দিয়ে তৈরি, দারুণ গন্ধ বেরুচ্ছে। তখনো গাঁয়ের দিকে খাবারে ভেজাল দেবার কথা কেউ ভাবতে পারত না।
জল ভরে মেটে কলসীটা নিয়ে ফিরে এল ময়রা। আমাদের পাশে নামিয়ে রেখে বলল—এই জল রইল। এ খাবারে হয়ে যাবে তো? নাকি আর কিছু এনে দেব?
খাবারের প্রাচুর্য সম্বন্ধে তাকে আশ্বস্ত করে বিদায় করা হ’ল। অমর বলল—অন্ধকারে গল্প করা যাবে, কিন্তু খাওয়া যাবে না। মোমবাতি বেশি পুড়িয়ে লাভ নেই, এসো খেয়ে নেওয়া যাক–