–আপনি কোথায় থাকেন?
বৃদ্ধ আমাকে কড়া চোখে তাকিয়ে দেখল, তারপর বলল—কেন বল তো?
—না, তাই জিজ্ঞেস করছি–
—আমি এই গ্রামেরই ভেতরে থাকি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে স্থানাভাব, সেখানে আশ্রয় দিতে পারব না।
হেসে বললাম—আপনার আশ্রয়ে থাকার চেয়ে গাছতলায় থাকা ভাল। ভয় নেই, থাকতে চাইব না, কথাটা এমনিই জিজ্ঞেস করেছিলাম। গাছপালারা অন্তত আশ্রয়গ্রহণকারীকে কটু কথা বলে না–
বৃদ্ধ আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে হুম্ শব্দ করে গ্রামের দিকে চলে গেল।
আমার পথ হাঁটার সম্বল বলতে একটা ঝোলা। তার মধ্যে একখানা ঘটি, গায়ের চাদর, একখানা রুদ্রডামরের পুঁথি, কয়েকটা বাবলাডালের দাঁতনকাঠি, আর একটাকা বারো আনা পয়সা। এর বেশি কিছুর প্রয়োজনও বোধ করিনি কখনো। পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসা সেই হিন্দিভাষী সাধু শিক্ষা দিয়েছিলেন আগামীকালের জন্য কোনও সঞ্চয় না করতে। তার উপদেশ মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। পরবর্তীকালেও যে উপার্জন বা সঞ্চয় করেছি, তা করেছি স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মঙ্গলের জন্য, নিজের প্রয়োজনে নয়। আজ পর্যন্ত সেই অভ্যাস বজায় রেখেছি।
ক্রমেই আকাশ মেঘে অন্ধকার করে আসছে। ঝোলাসহ নাটমন্দিরের ওপর উঠে একখানা থামের গোড়ায় গুছিয়ে বসলাম। বাঁকুড়া জেলায় গিয়েছ কখনো? বড় সুন্দর জায়গা। বিশাল বিশাল লালমাটির প্রান্তর, ঝুঁটিবাঁধা বৈরাগীর মত তালগাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে মাঠের মধ্যে, ধুলোওড়া গ্রামের রাস্তায় একতারা হাতে গান গাইতে গাইতে বাউল হেঁটে যাচ্ছে। জেলাটার মাটিতে শান্তি আছে। থামে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলাম।
হঠাৎ নাটমন্দিরের চাতালে কিছুদূরে কী একটা নড়ল বলে মনে হল। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে, পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না। কিন্তু কোনও কিছু নড়লে আবছা আন্দাজ করা যায়। ভাল করে তাকিয়ে দেখি কেউ একজন শুয়ে রয়েছে সেখানে, শোয়া অবস্থায় পাশ ফেরায়। নড়াচড়াটা চোখে পড়েছে। হেঁকে বললাম—কে? কে ওখানে?
মনুষ্যমূর্তিটি উঠে বসে বলল—আমি।
—আমি কে? পৃথিবীতে সবাই তো আমি। যাত্রী?
লোকটি সামান্য হাসল, বলল—সংসারে সবাই যাত্রী, কোথাও না কোথাও চলেছে।
বাপ রে! এ যে গুরুমশায়ের মত কথা বলে। তবে তার কণ্ঠস্বর মৃদু, ভদ্র ও মার্জিত। পথচলতি লোকের কথা বলার ভঙ্গি সাধারণত এমন মার্জিত হয় না। একটু কৌতূহল হওয়ায় বললাম—এসো, এদিকে এসে বোসো
লোকটি উঠে এল আমার সামনে। আলো নেই, পরিষ্কার তাকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু মনে হ’ল তার বয়েস বছর চল্লিশ কী পঁয়তাল্লিশ হবে। এ বয়েসের কোনও লোককে। ‘তুমি’ বলাটা আমার উচিত হয়নি। বললাম—কিছু মনে করবেন না, অন্ধকারে ভাল দেখতে পাইনি, তুমি’ বলে ফেলেছি।
—তাতে কী হয়েছে? জগতে সকলে সকলের বন্ধু। বন্ধুকে ‘তুমি’ বলা যায়।
লোকটির পরণে খাটো ধুতি আর হাফহাতা শার্ট। সাধারণ দরিদ্র পথিক। কিন্তু তার আচরণে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা সমীহ আদায় করে। বললাম কোথায় যাবেন? আসছেন কোথা থেকে?
এবার বেশ মজার ব্যাপার হ’ল। পথিক মানুষটি আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে লাগল, কিন্তু তার অনুমতি পাওয়া সত্ত্বেও আমি কিছুতেই তা পারলাম না। সে বলল—কোথাও যাচ্ছি না ভাই, অনেকটা তোমারই মতন। পথে পথে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে। যা পাই তাই খাই, যেখানে খুশি থেমে যাই—এই আরকি।
আমার সেই বয়েসের অভিজ্ঞতাতেই দেখেছি, কিছু লোক আছে যারা হেঁয়ালি করে। কথা বলতে ভালবাসে। ভেতরে শূন্যগর্ভ বলেই বোধহয় তারা বড় বড় দুর্বোধ্য কথা বলে। প্রথমে আমি এই লোকটিকে তাদের দলে ফেলেছিলাম, কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম তা সত্যি নয়। মানুষটার ভেতর গভীরতা আছে।
বললাম—আমারই মতন মানে? আপনি কী করে জানলেন আমি কী রকম?
-–ও জানা যায়। আমি বুঝতে পারি।
বয়েস অল্প হলেও তারই মধ্যে আমি অনেক সাধক এবং অদ্ভুতকর্মা তান্ত্রিকের সঙ্গে মিশেছি। তাদের আশ্চর্য ক্রিয়াকলাপ দেখেছি। এ আর আমাকে নতুন কী ভড়ং দেখাবে?
বললাম—কী করে বোঝেন? কাকচরিত্র বা লক্ষণশাস্ত্র চর্চা করেন নাকি?
—না। বুঝি এইভাবে যে, মন আসলে একটাই—তোমার আমার যদু কিম্বা মধুর, পৃথিবীর সব প্রাণীর। মায়ার আবরণে আলাদা আলাদা দেখায়। পর্দা টাঙিয়ে দিলে ওপারে কী আছে দেখা যায় না, পর্দা সরিয়ে দিলে আবার সব স্পষ্ট দেখা যায়। মায়ার পর্দা সরিয়ে দিলে সবই এক। তখন কারও মনের কথা জানতে অসুবিধে হয় না।
বললাম—আপনি তো বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের কথা বলছেন। এ দর্শন শিক্ষা করেছেন কোথায়? খুব ভাল গুরু ছাড়া অদ্বৈতবাদের পাঠ নেওয়া যায় না। কে আপনার গুরু?
—আমার বাবা।
—ও, আপনি বুঝি শাস্ত্রাধ্যায়ী পণ্ডিতের সন্তান?
সে চুপ করে রইল। ভাবলাম কোনও কারণে সে হয়ত নিজের পরিবারের কথা আলোচনা করতে চায় না। এক্ষেত্রে কথা না বাড়ানোই ভদ্রতাসঙ্গত হবে।
ঠিক এইসময় ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা ঝাপটা দিয়ে ঝড় এসে পড়ল। বর্ষাকাল হওয়া সত্ত্বেও সারাদিন প্রখর রোদুর ছিল, গুমোটে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এখন শুকনো পাতা ধুলোবালি আর কুটোকাটা উড়িয়ে ঝোড়ো বাতাস এসে চারদিকে ঠাণ্ডা করে দিল। ঝড়ের মুখে পাক খেতে খেতে দুটো শালিক এসে নাটমন্দিরের কড়িকাঠের ফাঁকে আশ্রয় নিয়ে গুছিয়ে বসল। অথবা ওইটাই ওদের বাসা, ঝড়ের দাপটে কোনওরকম ফিরে এসেছে।