সিগারেটের দগ্ধাবশেষ ছাইদানি হিসেবে ব্যবহৃত নারকেলের মালায় গুঁজে দিতে দিতে তারানাথ বলল—তা বলতে পার। একেবারে রক্তাম্বরধারী তান্ত্রিক কেউ না থাকলেও বাপ-ঠাকুর্দা-প্রপিতামহের ভেতর অনেকেই রীতিমত সাধকশ্রেণীর মানুষ ছিলেন। আমার আপন ছোট ঠাকুর্দা, মানে বাবার ছোটকাকা-তিনি কৈশোরেই গৃহত্যাগী হয়ে চলে গিয়েছিলেন। তাছাড়াও আমাদের পরিবারে নানাসময়ে নানান আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে, যার কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। আর কিছু কিছু তো তোমাদের বলেছি।
বললাম—আপনার ছোট ঠাকুর্দা আর কখনো সংসার জীবনে ফিরে আসেন নি?
–না। তবে একবার তার সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল। সেও এক বলবার মত গল্প—
–বলুন না, আজকের আসর সেইটে দিয়েই শুরু হোক।
তারানাথ বলল-এ কাহিনী আমার বাবার কাছে শোনা। বাবা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প বলতে পারতেন—এ বিষয়ে তাঁর নাম ছিল। আমাদের গাঁয়ের সরসী চাটুজ্জের বৈঠকখানায় সন্ধেবেলা বোজ জমাট আড্ডা বসত, বাবা ছিলেন সে আড্ডার প্রধান কথক। মেজাজ ভাল থাকলে বাড়ি ফিরে সেদিন কী গল্প হল আমাদের শোনাতেন। তারপর তো আমিও অল্পবয়েসে বাড়ি থেকে উধাও হলাম। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে আসি, তবে সে খুব কম। তিন-চার বছরে একবার কী দুবার। ওই ভবঘুরেমির সময়টা আমার যে কী সুন্দর কেটেছে তা আর কী বলব! কোনও পিছুটান নেই, দায়দায়িত্ব নেই, কেবল বিরাট এই পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো। বাইরে থেকে দেখলে এটা হয়ত স্বপ্নদর্শী অলসের জীবনযাত্রা বলে মনে হবে, যে বাস্তব জগতের থেকে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সোজা নয়। আত্মীয়হীন, বন্ধুহীন দুনিয়ায় সম্পূর্ণ সম্বলহীন অবস্থায় ভেসে পড়তে হলে খুব সাহসের দরকার। কে খেতে দেবে ঠিক নেই, কোথায় থাকব তার কিছু ঠিক নেই, মন্দিরের চাতালে, পোড়ড়া বাড়ির বারান্দায় ঝড়ে-বৃষ্টিতে রাত কাটিয়েছি। কত অদ্ভুত চরিত্রের লোক দেখেছি, তাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত সাধক, কেউ নৃশংস কাপালিক, কেউবা জুয়াচোর। কত সময়ে অসুখ করেছে, প্রবল জ্বরে পথের ধারে গাছতলায় পড়ে কষ্ট পেয়েছি, জলতেষ্টায় বুক ফেটে গিয়েছে, কিন্তু জল দেবার কেউ ছিল না। মরেও যেতে পারতাম। সেক্ষেত্রে বাড়িতে কোনও খবরও পৌঁছত না। তবু কখনো ভয় হয়নি। মৃত্যুকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দেখিনি, দেখেছি ঈশ্বরের তৈরি এই জগতের একটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে। যে পরিণতিতে ভয়ের কিছু নেই, আছে স্রষ্টার অপার করুণা।
এই পর্বেই বীরভূমের শ্মশানে মাতু পাগলীর সঙ্গে পরিচয়, বরাকর নদীর ধারে নির্জন শালবনে মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাব দেখতে পাওয়া। ওঃ, সেসব কী উত্তেজনাপূর্ণ দিন গিয়েছে। মনে হয়েছিল বুঝিবা সৃষ্টির সব রহস্য জেনে ফেলব, সাধনার তীব্রতায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মকানুন ধরা দেবে আমার চেতনায়–
কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থেমে গেল তারানাথ। বললাম—কেন, অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তো হয়েছে—
—তা হয়েছে। যা পেয়েছি তা একজন সাধকের একটা জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু আসলে তো কিছুই জানা হল না। এই জগতের মানে কী, কী করে এই চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি হল, না হলেই বা কী এসে যেত, সেই ভেতরের আসল কারণগুলো সব অজানা থেকে গেল। এখন মনে হয়–
আবার থেমে গেল তারানাথ। কী ভাবতে লাগল।
জিজ্ঞাসা করলাম-কী মনে হয়?
—মনে হয় সৃষ্টির গভীরতম কারণটা ঈশ্বর মানুষের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য আড়াল করে রেখেছেন। সে রহস্য জানতে পারলে সৃষ্টির আর কোনও সার্থকতা থাকবে না। গোলোকধাম খেলেছ তো? সেই যে কড়ি চেলে, কাগজে ছাপা ছকের ওপর গুটি এগিয়ে খেলা। জন্ম থেকে শুরু হয়ে বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, আদালত, পতিতালয়, শৌণ্ডিকালয়, মন্দির ইত্যাদির খোপে আঁকা ঘর পেরিয়ে খেলুড়েকে একটু একটু করে ওপরে উঠতে হয়। সবচেয়ে ওপরের খোপের নাম হচ্ছে গোলোকধাম। সেখানে পৌঁছলেই খেলা শেষ। তারপর ছক আর গুটি তুলে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। আমাদের জীবনেও তাই। সবকিছু জেনে ফেললেই খেলা শেষ। সেটা ভগবান চান না। তা একদিক দিয়ে ভালই, খেলা চলছে চলুক না।
দেখলাম তারানাথ গল্প থেকে দর্শনের দিকে সরে যাচ্ছে। বললাম-তারপর যে কথা বলছিলেন, আপনার অল্পবয়েসের গল্প, সেটা বলুন–
তারানাথ বলল—একবার বাঁকুড়ার ইন্দাস অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সারাদিন হাটেমাঠে ঘুরি, রাত্রে যেখানে হোক আশ্রয় নিই। সেদিন বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা, বেশি পথ না হেঁটে আলো থাকতে থাকতে একটা ছোট গ্রামের সীমানায় শিবমন্দিরের চাতালে আশ্রয় নিয়েছি। বেশ বড় চওড়া চাতাল, আট-দশটা থামের ওপর ছাদ রয়েছে। কাজেই ওপরটা ঢাকা, বৃষ্টি হলেও ভিজতে হবে না। গায়ে উড়নি, পায়ে খড়ম এক পৈতেধারী বুড়োমত লোক দেখি মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে কোথায় যাচ্ছে। মনে হল এখানকার পূজারী। এগিয়ে গিয়ে বললাম—আজ্ঞে, এখানে রাত্তিরটা একটু থাকা যাবে?
লোকটি একান্ত নীরস এবং অমিশুক প্রকৃতির। কিছুক্ষণ আপাদমস্তক আমাকে ভাল করে দেখে সে শুকনো গলায় বলল—থাকতে ইচ্ছে হলে থাকো, আমাকে জিজ্ঞাসা করার কী প্রয়োজন?
—না, ভাবলাম আপনিই বোধহয় এ মন্দিরের পূজারী। কাজেই আপনার অনুমতি নেওয়াটা–
—কিছু দরকার নেই। আমি এখানকার পূজারী বটে, কিন্তু নাটমন্দিরে যে কোনও যাত্রী আশ্রয় নিতে পারে। তবে এখানে অতিথিশালা নেই, খাবারদাবার দেবার ব্যবস্থাও নেই। থাকার মধ্যে ওই নাটমন্দির, থাকতে চাইলে থেকে যাও।