রাম গাঙ্গুলির গল্প শেষ হতে সবাই কিছুক্ষণ চুপ, তারপর পতিরাম মজুমদার বললেন–সরসী ভায়া, এবার কিন্তু আমাকে উঠতেই হবে। কিন্তু এরপর তো আর একা যেতে পারব না, গা ছমছম করবে। তুমি বলেছিলে তোমার লোক সঙ্গে যাবে, তাই একজন কাউকে দাও। ঠাট্টা করলে কর ভাই, আমি অপারগ—
সরসী চাটুজ্জে বললেন-কেউ ঠাট্টা করছে না, তোক দিচ্ছি সঙ্গে।
আদিনাথ চক্রবর্তী বললেন—ওঠবার আগে আমার কাহিনীর শেষটা বলি—
পতিরাম বললেন—এখনো শেষটা বাকি।
—ভয় নেই, দুটো কথা মাত্র। অমর বিষ্ণুমূর্তি খুঁজে দিয়ে গিয়েছিল, ঠাকুমার মৃত্যুর পর তার ভবিষ্যৎবাণী যে সত্যি সে কথা জানান দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার তৃতীয় ভবিষ্যৎবাণীটাও যে সত্যি, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম অনেক পরে। সে বলেছিল আমাদের বংশে একজন অদ্ভুত চরিত্রের উদাসীন সাধকের জন্ম হবে। সংসারী হয়েও সে বৈষয়িক হবে না। কবে, কোথায় কার ঘরে তার জন্ম হবে সেটাই কেবল সে বলেনি। শুধু বলেছিল এই শিশুর জন্মের মুহূর্তে আশ্চর্য এক নীল উল্কাপাত হবে আকাশে। তা দেখলে আমরা বুঝতে পারব।
বহুদিন পরে, তখন ছোটবেলার এ কাহিনী প্রায় ভুলেই গিয়েছি, আমার তৃতীয় ছেলের জন্মের সময় আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এক বিশাল নীল রঙের আলো ছড়ানো উল্কা ছুটে গেল। একজন দাই আঁতুড়ঘর থেকে উঠোন পেরিয়ে গরমজল আনতে যাচ্ছিল ভেতরবাড়িতে, তার চিৎকারে সকলে উঠোনে বেরিয়ে এসে দৃশ্যটা দেখলাম। সচরাচর অতক্ষণ ধরে উল্কা জ্বলতে জ্বলতে অতটা আকাশ পার হয় না। সেই আলো মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ছেলের জন্ম। তার নাম তারানাথ। তারানাথ চক্রবর্তী।
আদিনাথের এক ছেলে ছোটবেলা থেকেই সংসারত্যাগী। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে, আবার কোথায় চলে যায়। এটা তার জীবনের গভীর ব্যথার জায়গা। আড্ডাধারীরা সেকথা জানেন বলে চুপ করেই রইলেন। আদিনাথ বললেন—এখন তার বয়েস বাইশ কী তেইশ। কোথায় আছে কে জানে। বছরখানেক আগে একবার সাতদিনের জন্য এসেছিল, তারপর আবার নিরুদ্দেশ। ছেলে আমার খুবই ভাল, চমৎকার সংস্কৃত জানে, পণ্ডিতেরা তার সঙ্গে পেরে ওঠে না। কোথা থেকে শিখল সে এক রহস্য। স্কুল-কলেজে তো কখনো পড়েনি। দোষের মধ্যে ওই এক বাড়িতে মন বসে না। জানি না আবার কবে তার দেখা পাব।
আড্ডাধারীরা তারানাথকে দেখেছেন। আট-দশ বছর আগে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তার আগে অবধি এই গ্রামেই সে মানুষ হয়েছে। সমবেদনাসূচক নীরবতা পালন করা ছাড়া তাদের কিছু করবার নেই।
আদিনাথ বললেন—যাক, আমার ভাগ্য। আপনারা আশীর্বাদ করুন, সেখানেই থাকুক, সে যেন ভাল থাকে।
০৪. এতক্ষণ এ গল্প শুনছিলাম
এতক্ষণ এ গল্প শুনছিলাম তারানাথের মুখে।
মট লেনে তারানাথের বাড়িতে আমাদের চিরাচরিত আড্ডা বসেছে। আজ ছিল জন্মাষ্টমীর ছুটি। দুপুরের পরেই কিশোরী সেন আর আমি গল্পের লোভে হানা দিয়েছি তারানাথের বৈঠকখানায়। চারির বিয়ে হয়ে যাবার পর তারানাথ বোধহয় মনের দিক দিয়ে একটু অসহায় হয়ে পড়েছে। মেয়েরা বাপের যতখানি সেবা করে, ছেলেরা ততটা পারে না। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার পর তারানাথের মুখচোখে একটা ভরসা-হারা ভাব ফুটে ওঠে মাঝে মাঝে। আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা করি না।
কী হবে প্রৌঢ় মানুষের মনে বিষণ্ণতার বোঝা বাড়িয়ে?
আজ তারানাথের বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়তে দরজা খুলে দিল চারি। অবাক হয়ে বললাম—একি রে! কবে এসেছিস তুই? গত হপ্তাতেও তো আমরা এসে গল্প করে। গিয়েছি, তোর বাবা তো বলেন নি তুই আসবি!
হাসিমুখে চারি বলল—না কাকাবাবু, আসার কথা ছিল না, গতকাল হঠাৎ এসে পড়েছি। ব্যবসার কাজে আপনাদের জামাইকে কলকাতা আসতে হ’ল, আমি ধরে পড়লাম—আমিও যাব। তাই
বললাম—জামাই তোর কথা সব খুব মান্য করে, তাই না?
চারি সলজ্জ হেসে মুখ নিচু করল। সে চিরকালই সপ্রতিভ, কিন্তু প্রগভা নয়। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখছি, কন্যার মত স্নেহ জন্মে গিয়েছে তার ওপর। আগে আগে তার জন্য লেসের ডিজাইন, ছবিওয়ালা গল্পের বই ইত্যাদি নিয়ে আসতে হত। গতবছর। ভাল ঘরে-বরে বিয়ে হয়েছে চারির। স্বামী মাঝারি ধরনের ব্যবসা করে, বিশাল ধনী নয়, কিন্তু সচ্ছল অবস্থা। ছেলেটিও ভাল, বিনয়ী এবং সচ্চরিত্র। এত ভাল পাত্রে মেয়ের বিয়ে দেবার ক্ষমতা তারানাথের ছিল না, কিন্তু চারি সুন্দরী বলে দেনাপাওনা কোনও বাধা হয়নি।
চারি বলল—আপনারা ভাল আছেন তো কাকাবাবু? আসুন, ভেতরে এসে বসুন।
একটু পরেই তারানাথ বাড়ির ভেতর থেকে বৈঠকখানায় এসে বসল। তার মুখ আজ উজ্জ্বল, গত একবছরের ম্রিয়মাণ ভাবটা কেটে গিয়েছে। সে বলল-এসো হে দুই মূর্তি, আজ ছুটির দিন, আমি জানতাম তোমরা আসবে। তোমাদের বউদিদি ক্ষীরের মালপোয়া করেছেন, খেয়ে যাবে–
কিশোরী বলল—চারি এসেছে, বাড়ির চেহারাই দেখছি বদলে গিয়েছে। সত্যিই, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে মনে খুব আনন্দ হয়, তাই না?
—ঠিক। তাও এখন তো বুদ্ধি দিয়ে বুঝছ, আমার বয়েসে এলে হৃদয় দিয়ে বুঝবে।
যথাসময়ে চারি চা নিয়ে এল। আজ সব একদম সময়মাফিক ঠিকঠাক চলছে। আমরা আসবার সময় মোড়ের দোকান থেকে কিনে আনা তারানাথের প্রিয় সিগারেট পাসিং শোএর প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলাম। এটা না হলে তারানাথের গল্পের মেজাজ আসে না। নানারকম কথা হতে হতে নিজের ছোটবেলার গল্প বলতে আরম্ভ করল তারানাথ। সাধারণত সে নিজের পুরনো জীবন সম্বন্ধে কিছু বলতে চায় না, অন্তত সাধারণ পারিবারিক তথ্যগুলো আলোচনা করে না। বেছে বেছে কেবল অদ্ভুত আর অলৌকিক অভিজ্ঞতার গল্প শোনায়। আজ হঠাৎ কিশোরী জিজ্ঞাসা করল—আপনি তন্ত্রসাধনার উৎসাহ বা প্রেরণা পেলেন কোথা থেকে? আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কি কেউ তন্ত্রসাধক ছিলেন? মানে আমি বলতে চাইছি যে, এর ধারাটা কি পরিবারে আগে থেকে ছিল?