- বইয়ের নামঃ অলাতচক্র
- লেখকের নামঃ তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. উনিশ শো পনেরো সাল
উনিশ শো পনেরো সাল। ইউরোপে প্রথম মহাসমর সবে শুরু হয়েছে। কিছু বছরের ব্যবধানে যে দুটি বিশ্বযুদ্ধ মানবেতিহাসকে আমূল বদলে সম্পূর্ণ নতুন পথে প্রবাহিত করবে, তার আভাসমাত্রও কেউ তখনো জানে না। যুদ্ধ একটা হচ্ছে বটে, যারা নিজের জনপদের বাইরে কর্মসূত্রে যাতায়াত করে, তারা খবরটা জানে। কিন্তু সে যুদ্ধ হচ্ছে অন্য মহাদেশে, ভারতে তার বিশেষ কোনো ঢেউ এসে লাগেনি। লোকপরম্পরায় শ্রুত কিংবদন্তীর মত তা সামান্য ঔৎসুক্য জাগায় মাত্র, মানুষকে সন্ত্রস্ত বা উদ্বিগ্ন করে না। সবুজ গাছপালায় ঢাকা শ্যামমিন্ধ গ্রামবাংলার জীবন চিরাচরিত ধীরলয়ে বয়ে চলেছে। হুগলী জেলার অন্তঃপাতী এমনই একটি ছোট গ্রামে এই কাহিনীর শুরু।
তারকেশ্বর লাইনের সিঙ্গুর স্টেশনে নেমে আট-দশ মাইল হেঁটে কিম্বা গরুর গাড়িতে গেলে পড়বে রামজয়পুর গ্রাম। গ্রামটি ব্রাহ্মণপ্রধান, কায়স্থ এবং বৈদ্যের বাসও কিছু রয়েছে। গ্রামের প্রত্যন্তসীমায় শ্রমজীবী অন্যজাতির কয়েকটি পরিবার বাস করে। কিন্তু সেই যুগে সমাজে যে জাতপাত-ঘটিত বৈষম্য বিরাজ করত, রামজয়পুরে তার নামগন্ধও ছিল না। ভাগ্যের আশ্চর্য যোগাযোগে এখানে কিছু উদার ও ভদ্র মানুষ একজায়গায় হয়েছিল। তারা হাসিমুখেই বাস করত গ্রামে। প্রতিবেশীর সুখ এবং শান্তি সচরাচর কারো সহ্য হয় না, তাই কাছাকাছি দু-একটি গ্রাম থেকে সমাজপতিদের প্রতিনিধিরা এসে মাঝেমধ্যে বিরোধ তৈরি করার প্রচেষ্টা যে করেনি এমন নয়, কিন্তু রামজয়পুর সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।
শ্রাবণ মাসের শেষের দিক। দিন তিনেক হল অবিশ্রাম বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কখনো সামান্য ধরে আসে, একটু বাদেই আবার ঝমঝমিয়ে নামে। গ্রামের ভেতরে প্রায় সব রাস্তাতেই কমবেশি কাদা। পথে লোক চলাচল নেই। কে আর এমন দুর্যোগে অকারণে ঘর ছেড়ে বেরুবে? চাকরির জন্য কলকাতায় নিত্যযাত্রার প্রচলন তখনো এমন ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়েছিল, তারা সারা সপ্তাহ কলকাতার মেসে থেকে শনিবার বাড়ি আসত, আবার সোমবার সকালে ফিরে যেত। লোকে নিজের ভদ্রাসনেই বাস করত, পারিবারিক জমিজমা আর আমকাঠালের বাগানের উপস্বত্বে সংসার চলে যেত সচ্ছলভাবেই। চাহিদা কম থাকায় জীবনে সুখ ছিল।
আকাশে মেঘ থাকায় সন্ধে নেমেছে একটু তাড়াতাড়ি। সরসী চাটুজ্জের বৈঠকখানায় সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছে দারুণ। বেশ বড় বাড়ি, তারপরে দুর্গামণ্ডপ আর নাটমন্দির। নাটমন্দির পার হয়ে দুদিকে দেউড়ির ভেতর দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পথ। এরই ডানদিকে বড় বৈঠকখানা। চৌকি বা তক্তাপোশ নয়, মেঝেতে মোটা সতরঞ্চি পাতা, তার ওপর সাদা ফরাস। একসঙ্গে পনেরো-কুড়িজন বসে আড্ডা দিতে পারে। সরসী চাটুজ্জের আড্ডা এ গ্রামে বিখ্যাত। এমন ঢালাও তামাকের ব্যবস্থা আর কারো বাড়ি নেই। তাছাড়া আর মধ্যে অন্তত একবার কাঁসার বাটিতে করে সরষের তেল দিয়ে জবজবে করে মাখা মুড়িহোলাভাজা আসবেই। সরসী চাটুজ্জের উঠোনে বাইশ হাত বেড়ের ধানের গোলা চারটে, ধান ছাড়াও বিভিন্ন রকমের শস্য আর সবজির চাষ আছে বহু বিঘের। আপ্যায়নের বিষয়ে তার কষ্ট হবার কথা নয়। গ্রামবৃদ্ধেরা রোজ ভিড় করেন তাঁর বাড়িতে।
আজ হচ্ছিল গল্পের রাজা-ভূতের গল্প। বাড়ির ভেতর থেকে চালভাজা-ছোলাভাজা এসে গিয়েছে, হুঁকো ঘুরছে হাতে হাতে। ঘরের কড়িকাঠ থেকে লোহার বাঁকানো হুকে ঝুলছে হিঙ্কসের ডবল পলতের বাতি। সজল বাতাসে সেটা সামান্য দুলছে, ফলে আচ্ছাধারীদের ছায়া দুলছে বৈঠকখানার দেয়ালে। আলোছায়ার মায়ায় জমে উঠেছে অপ্রাকৃত গল্পের আসর।
আদিনাথ চক্রবর্তী বললেন—তোমরা বেশির ভাগই শোনা কথা বলছ, নিজেরা কিছুই দেখোনি। ওসব গল্পের মূল্য কী?
নিবারণ ভাদুড়ি হুঁকোটা রাম গাঙ্গুলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন-সরসী, এ ভ্যালসা তামাক কোত্থেকে জোগাড় করলে? গলায় একটু সেঁকও লাগে না ছাই! একটু ভদ্র তামাকের ব্যবস্থা করা, নইলে নিজের তামাক ট্যাকে খুঁজে আড্ডায় আসতে হবে। আর হ্যাঁ, আদিনাথ, তুমি তো বড় বড় কথা বলছ। নিজে কী দেখেছ বল, আমরা একটু শুনি। কেবল বাগাড়ম্বর করে তো বাজার গরম হবে না—
সরসী চাটুজ্জে বললেন–সেই ভাল। চক্কোত্তিমশাই এতক্ষণ চুপ করে শুনে যাচ্ছিলেন, এবার ওঁর গল্পই হোক—
আদিনাথ বললেন—গল্প নয়, সত্য কাহিনী।
–বেশ তো, তাই হোক।
পতিরাম মজুমদার একটু ভালমানুষ ভীতু ধরণের লোক। আড্ডায় অনেকক্ষণ ধরে ভূতের গল্প তার পছন্দ হচ্ছিল না। এবার তিনি একটু সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন–আজ এই পর্যন্ত থাকলেই ভাল। দেখছ তো আকাশের গতিক, বেশি জোরে নামলে আর বাড়ি ফেরা মুশকিল হয়ে পড়বে। শুনছ মেঘের ডাক?
সরসী চাটুজ্জে হেসে বললেন—আরে বোসো। আমার চাকর তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে এখন–
পতিরাম হতোদম হয়ে বসে পড়লেন।
আদিনাথ বললেন–তামরা তো জানো, শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি পেয়ে আজ সতেরো বছর হল আমি এই গ্রামে এসে বাস করছি। আমার ছোটবেলা এবং বিবাহিত জীবনের প্রথম কয়েকবছর কেটেছে পৈতৃক গ্রাম বাহিরগাছিতে। সেখানে আমাদের তিনমহলা বাড়ি, বাপ-জ্যাঠা পিসি-খুড়ি আর একগাদা ছেলেপুলে নিয়ে সে বাড়ি গমগম করত সর্বদা। নিজেদের মধ্যে ভাব-ভালবাসা ছিল। এখানে বাস করতে আসি ঝগড়া করে নয়, কোনো বিরোধের জন্যও নয়। এসেছিলাম বাবার কথায়। তিনি বলেছিলেন—আদিনাথ, আমার কথা শোনো। তুমি রামজয়পুরে গিয়ে বাস করো, অন্তত কিছুদিনের জন্য। বৌমার বাবা গত হয়েছেন, রয়েছেন কেবল বেয়ানঠাকরুণ। তিনিও শয্যাগতা। তাকে দেখাশুনো করা তোমাদের কর্তব্য। তাছাড়া কিছু মনে কোরো না-যতদূর জানি তাদের সম্পত্তির পরিমাণও কম নয়। বৌমাও তাদের একমাত্র সন্তান, সবকিছু তারই প্রাপ্য। এ সময়ে সেখানে উপস্থিত থেকে নিজেদের জিনিস বুঝে নেওয়া ভাল। আর এই বাড়িতেও তো ক্রমেই স্থানাভাব ঘটছে দেখতেই পাচ্ছ। লোকসংখ্যা বাড়ছে, সে তুলনায় থাকার জায়গা বাড়ছে কই? যদি আলাদাও থাক, তাতে প্রীতির ভাব কমবার কারণ নেই। যাওয়া-আসা বজায় রেখো, সেটাই বড় কথা।