ভোরবেলা সূর্য উঠবার এখনও অনেক দেবী (কারণ, সূর্য উঠলে আর পূজা হবে না) ছেলে মেয়েরা সব বেদীর চারদিক ঘিরে বসে শুরু করে বন্দনা গাইতে :—
উঠরে উঠরে সূজ্জ্য উদয় দিয়া,
বায়ণ বাড়ির পাছ দিয়ে।
বায়নের মেয়েরা বড়ই সিয়ানা,
পৈতা জোগায় লো অতি বিয়ানা।
এরপর একে একে বলে যায় অনেক ছড়া। পূর্বেই বলেছি এসব ছড়ার ভিতর নির্দিষ্ট কোনো নীতি বা রীতি নেই। এর ভিতর একাধারে বিয়ের ছড়া থেকে বিরহের সব কিছুই থাকা সম্ভব। যতক্ষণ না সূর্য উদিত হয় ততক্ষণ এইভাবে ছড়ার পর ছড়া বলতে থাকে, তারপর যে যার ঘরে চলে যায়। আবার সবাই এসে জোটে সন্ধ্যা বেলা। এইবার ধূপ, দীপ সব জ্বালিয়ে দেয় সেই বেদীর উপর। হাতের ফুল ছিটাতে ছিটাতে তারা আবার শুরু করে ছড়া বলতে। একে বন্দনা গীতিও বলতে পারেন :—
সাজ এসরে সাঁজনা গীতি।
ক্যানরে সবে এত রাই।।
বাড়ির কাছে ভাঙা বন।
তাই ভাঙ্তি এতক্ষণ।।
এক কড়ার ঘুটি মুচি দুই কড়ায় ঘি।
সাজ পরদীপ লাগাল বয়ণগের ঝি।।
বায়ণ ঝি, বায়ণ ঝি বলে আলাম তোরে।
তোর গৌরাঙ্গের বিয়ে শনি মঙ্গল বারে।।
এ ছাড়া আরতিত ছড়াও আছে আলাদা। প্রদীপ হাতে নিয়ে ছেলে মেয়েরা বেদীর সুমুখে আরতি করতে করতে সমস্বরে ছড়া গায় :—
গঙ্গা পার করহে, না করিলে পার।
হাতের বাজু বাঁধা থুয়ে মারব সাঁতার।।
সকল সখি পার করিতে লাগবে আনা আনা।
রাধিকারে পার করিতে লাগবে কানের সোনা।।
আমরাতো গোপের মেয়ে সোনা কথায় পাব।
হাতের বেসাতি ভাসে গেলি উপোস করে রব।।
নলোক দেবে, বাজু দেবে, দেবে কানের ফুল।
তবেই না নিয়ে যাব ওপারেরি কূল।।
পাঠকগণ নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন এ ছড়ার সঙ্গে বনদুর্গার কোথাও কোনো সম্পর্ক মাত্রই নেই। এ পূজাও যেমনি বালকদের তেমনি এ ছড়াগুলিও প্রায়ই তাদের রচনা। তারা বুড়ো-বুড়িদের মুখে রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণের কাহিনী যেরূপ শোনে সেগুলিই তারা ছড়ার আকারে এখানে পরিবেশন করে।
বনদুর্গার পূজার তাৎপর্য সম্পর্কে যতটুকু যানা যায়, এ পূজা করলে নাকি ফোঁড়া, পাঁচড়া প্রভৃতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের, ‘পাঁচড়া পূজা’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘ঘেঁটু’ পূজার বেশ সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে। এই প্রসঙ্গে বনদুর্গার প্রণাম মন্ত্রটি লক্ষ্য করা যাক। এর ভিতর দেখা যায় এঁকে বলা হয়েছে, ‘হে দেবতা (ঠাকুর) তুমি ফোঁড়া, পাঁচড়া প্রভৃতি নিয়ে চলে যাও, আবার যখন আসবে তখন টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় নিয়ে এসো’ :—
এবার যাওরে ঠাকুর ফোট পাঁচড়া নিয়ে।
আবার এসো ঠাকুর শঙ্খ শাড়ি নিয়ে।
এই ভাবে গোটা মাঘ মাসটা পূজা করবার পর সংক্রান্তির দিন বিকালে ছেলেরা মহা উল্লাসের সাথে সেই বেদীতে সঞ্চিত এক মাসের ফুল, দূর্বা গুছিয়ে নিয়ে নিকটস্থ কোন জলাশয়ে বিসর্জ্জন দিয়ে আসে।
১.১৪.১২ ভাই-ফোঁটা
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – ভাই-ফোঁটা
‘ভাই-ফোঁটা’ সম্পর্কে বাঙালী সমাজের কাছে খুব বেশী কিছু বলবার দরকার হবে বলেতো আমার মনে হয় না। ‘ভাইফোঁটা’ হল ভাইয়ের জন্য বোনের মঙ্গল কামনা। সারা বছরই বোন সে ছোটই হউক, কি বড়ই হউক, দাদা বা ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু না কিছু পেয়ে আসছে, শুধু এই দিনটিতেই বোনের কাছে ভাইয়ের প্রাপ্য। এর সঙ্গে নেপালীদের “তিওহার” উৎসবের একটা বেশ মিল আছে। ভাই-বোনের যে মধুর সম্পর্ক—তাকে ভিত্তি করে ভারতের অন্যান্য জায়গায়ও অন্য রকম উৎসব চালু আছে। আপাততঃ আমাদের বাংলার ‘ভাই-ফোঁটা’ উৎসবের সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক।
কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিকেই বলা হয় ভাতৃদ্বিতীয়া বা ভাই-দ্বিতীয়া। কেউ কেউ বলেন ‘যম-দ্বিতীয়া’। ফলশ্রুতি অনুসারে যমরাজের ভগ্নী যমুনা এই বিশেষ দিনে যমরাজকে ভাই-ফোঁটা দিয়েছিল। সেই থেকেই এই প্রথাটির প্রচলন। এর ছড়ার ভিতরও এর যেন একটু আভাস মেলে। এই দিন ভোর থেকেই প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে বোনেদের ভিতর সাজ সাজ রব পড়ে যায়। কেউ কেউ এই দিনে ভাইকে কী কী খাওয়াবে সেই নিয়ে আগে থেকেই জল্পনা-কল্পনা শুরু করে, তার ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুতও হয়। কেউ কেউ যতক্ষণ না ভাইয়ের কপালে, ফোঁটা দেওয়া হয় ততক্ষণ জলস্পর্শও করেনা। কোথাও সকালে কোথাও বা প্রদোষে (সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে) ভাই-ফোঁটা দেবার প্রথা আছে। অনেকের ভিতর আবার ভাই-ফোঁটায় বারদোষ দেকেহো সে বছর ভাই ফোঁটা বন্ধ থাকে। তাদের শনি-মঙ্গলবার ভাই-ফোঁটা পড়োলে তারা ফোঁটা দেয়না, শুধু ভাইয়ের হাতে খাবারের থাকা তুলে দেয়। অনেকেই খাবারের সঙ্গে ভাইকে নতুন জামা কাপড় দিয়ে থাকে। যার যেমন সাধ্য, সে সেই ভাবেই ভাইকে ফোঁটা দেয়। তাদের বিশ্বাস এই দিন এই ছড়া বলে ভাইকে চন্দন তিলক পরিয়ে দিলে ভাইয়ের পরমায়ু বৃদ্ধি হয়।
সকালে বা সন্ধ্যায় যখনই হোক না কেন, ভাইকে বসান হয় পিঁড়ি অথবা কোনো আসনের উপর। তার সামনে জ্বালিয়ে দেয় প্রদীপ, আর সুমুখে থাকে একখানা বাটা, তাতে থাকে ধান, দূর্বা প্রভৃতি। এরই পাশে থাকে এক থালা (যার যেমন সাধ্য) মিষ্টি সামগ্রী।
ভাই প্রথমে বোনের দেওয়া নতুন কাপড় পরে বসে এসে পিঁড়ি বা আসনের উপর। বোন পানের বোঁটায় করে কাজল পরিয়ে দেয় ভাইয়ের চোখে, তারপর বাঁ হাতের কনিষ্ঠা অঙ্গুলীর সাহায্যে চন্দন নিয়ে ভাইয়ের কপালে পড়িয়ে দিতে দিতে মন্ত্র (?) বা ছড়া বলতে থাকে :—