পুণ্যি পুকুর পুষ্প মালা
কে পূজেরে দুপুর বেলা,
আমি সতী নিজ ব্রতী
সাত ভাইয়ের বোন ভাগ্যবতী,
হবে পুত্র মরবে না,
চোখের জল পড়বে না,
পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে
মরণ যেন হয় এক গলা গঙ্গাজলে।
চার বছর ধরে ঠিক একই নিয়মে এই ব্রত করে শেষ বছর করতে হবে উদযাপন। এইবার পুরোহিত ডাকতে হবে, তিনি শাস্ত্রীয় পূজানুষ্ঠান করবেন। অশ্বত্থ নারায়ণের ব্রতের মতো, এ ব্রতেও লাগে সোনার ও রূপোর তৈরি মাছ, বেলপাতা ইত্যাদি। সাধ্যানুসারে নিমন্ত্রণ অথবা ব্রাহ্মণ ভোজন এতো আমাদের ধর্মের একটা অঙ্গই।
১.১৪.০৭ ইতু পূজা
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – ইতু পূজা
অগ্রাহয়ণের সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এই একটা মাস প্রতি রবিবার ভোরে বাসী বিছানায় বসে পশ্চিমবঙ্গের পুরনারীদের দেখা যায় ইতুপূজা করতে। ইতু শস্যের দেবী। একটি মাটির সরার উপর মাটির ঘট বসাতে হয়। এই মাটির ঘটই হলো ইতু ঘট। ঘটটি পূর্ণ করা হয় দুধ দিয়ে। ঘটের মধ্যে দেয় কল্মী ফুল ও আম্ রপল্লব; তাছাড়া সরার উপর পুঁতে দেওয়া হয় ধানের শীষ, যবের শীষ, কল্মীলতা, কচু গাছ। এই ব্রত না করে ব্রতীরা জল খায় না।
ইতু পূজার উদ্দেশ্য হলো সংসারের সুখ ও ঐশ্বর্য কামনা। পূর্ববঙ্গে একেই বলে ‘চুঙ্গির ব্রত’। চুঙ্গি অর্থে চোঙ্গ। সেখানে ঘটের পরিবর্তে বাঁশের চোঙ্গ ব্যবহার করা হয়—এইমাত্র পার্থক্য। সাধারণতঃ ব্রতী নিজেই এই ব্রতের ছড়া বলে সেদিনের মতো ব্রত সাঙ্গ করে।
কোথাও কোথাও পাড়া-প্রতিবেশীরা একত্র হয়ে বসে একজন ইতুর ব্রত কথা বলে, আর ব্রতীরা হাতে ফুল নিয়ে বসে বসে শুনে যায় ব্রত কথা :
অষ্ট লোক পালনী মাতা সংসারের সার
জগৎ পালনে মাতা যারে অবতার।
খণ্ডিয়া পাপ দারিদ্র্য সকল
সকল বিপদে বন্ধন হয় যায় রসাতল।
তোমার মহিমা কে কহিতে পারে
তোমার মহিলা (ও গো) কে বুঝিতে পারে,
একচিত্ত হয়ে যেবা যম লোক তরে।
ধর্মরাজ বলে আয়লেন নরপতি,ব্
রাহ্মণ কুলে তারা ব্রাহ্মণে বিদ্যাবতী।
জয়া-বিজয়া তার কন্যা দুইখানি,
অরণ্য ভ্রমিয়া তারা নানা দ্রব্য আনে
প্রভাতে ভিক্ষার তরে আইলেন দ্বিজবর
বনের মধ্যে আছে এক সরোবর।
স্ত্রী সহ পুরুষ সহ কাটত বিধি
নিয়ম করিয়া তারা দিলেন তিন ডাক
আসিবারে দিব বরত বিস্তর
না আসিব দিব শাপত বিস্তর,
কর পাঠ, কর রানী, কর নমস্কার।
হাসিতে খেলিতে গেল যত নারীগণ
শনিবার সপ্তমীতে থাকিবে নিয়মে
রবিবারে ব্রতের কথা শুনিবে প্রভাতে
দুইভগ্নী ব্রত করে, করে একমনে,
দুই বোনে কথা শোনে শোনে একমনে।
কাটিলেন অশ্বারিয়া মঙ্গল আঁকিয়া
রাজা লয়ে যান হস্তে ধরিয়া।
ললাট লিখন রাজা হের বিধির ফল
কাটিল অষ্টম বুড়ি বছর অষ্টম সুফল
হাড়িকীর ব্রতের কথা হল সমাপন
যারে যা মনবাঞ্ছা করহ পূরণ।
গোটা মাস এইভাবে ব্রতকথা শুনে পৌষ সংক্রান্তির দিন সেই সরায় বসানো ঘট এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সহ মেয়েরা দল বেঁধে যায় নদীর ঘাটে কিংবা পুষ্করিণীর পাড়ে। একে একে টুসু ভাসান দেবার মতোই তারা ভাসিয়ে দেয় তাদের যার যার ইতুর ঘট ও সরা। সাঙ্গ হয় ইতু পূজার পালা সে বছরের মতো।
১.১৪.১০ গো-ক্ষুর ব্রত
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – গো-ক্ষুর ব্রত
‘গো-ক্ষুর’ ব্রত—কোনো কোনো জায়গায় বলে গোরুর ব্রত। কৃষিপ্রধান ভারতে গো-জাতির স্থান অতি উচ্চে। তার কাছে মানব সমাজের ঋণ অনেক। তাই তাকেও দেবতা জ্ঞান পূজা করতে তাদের বাধেনি। পৌষ মাসের শুক্লা তৃতীয়ায় (অথবা অন্য কোনো দিন) দেখা যায় বাড়ির গিন্নীরা অতি ভোরে উঠে বাড়ির গোহালঘর নিকোয়, তারপর গাভীগুলির (স-বৎসা হলে তো কথাই নেই) শিং-এ তেল মাখায়, কপালে সিন্দুরের টিপ দেয়, দেয় চন্দন কুম্কুমের ফোঁটা, তারপর গলায় পরিয়ে দেয় মোটা একছড়া ফুলের মালা। এরপর বাড়ির এবং পড়শী মেয়ে বৌরা সবাই এগিয়ে আসে ব্রত করতে। প্রথম গোরুর ক্ষুরে দেয় জল—তারপর তার মুখের কাছে ধরে দেয় আলোচাল, ফল প্রভৃতি দিয়ে সাজানো নৈবেদ্যের থালা। ব্রতীরা ধূপ দীপ জ্বালিয়ে প্রকৃতপক্ষে দেব মূর্তিকে পূজা করার ভঙ্গিতেই গলবস্ত্র হয়ে গাভীর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে :
গো গোবিন্দ সুরধুনী,
চার ক্ষুরে দিয়ে পানী।
মাথায় নৈবেদ্য মুখে ঘাস,
বর্তীরা গ্যাল স্বর্গ বাস।
এই দিন গাভীকে আর বাঁধা হয় না, সে নিজের ইচ্ছামত চরে বেড়ায়। সন্ধার দিকে গোহালে ফিরলে আবার তার সুমুখে ধূপ দীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, আর দেওয়া হয় এক আঁটি করে নতুন ঘাস।
১.১৪.১১ বনদুর্গার পূজা
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – বনদুর্গার পূজা
মাঘ মাস পড়বার সাথে সাথেই পল্লীবাংলার বিশেষ করে যশোহর, নদীয়া ও চব্বিশ-পরগণার কোনো কোনো অঞ্চলে বালক বালিকারা শুরু করে দেয় ‘বনদুর্গার’ পূজা। তবে এর জন্য তৈরী হতে থাকে প্রায় দশ বার দিন আগে থাকতেই। এই সময় মধ্যে তারা প্রচুর পরিমানে পূজার ফুল সংগ্রহ করে। ফুলই বনদুর্গা পূজার প্রধান উপকরণ। যে কোনো ফুল দিয়েই এ পূজা হতে পারে। কয়েক বাড়ি বা ঘরের ছেলে মেয়ে মিলে এক একই ছোট দল তৈরী করে নেয় নিজেদের ভিতর। তারপর তারা নিজেদের পূজার জন্য একটি বেদী তৈরী করে। মাঘ মাসের পয়লা থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন অতি ভোরে এবং সন্ধ্যায় দলের ছেলে মেয়েরা এসে ঘিরে বসে সেই বেদী মণ্ডপ। তারপর তারা শুরু করে পূজা। এই পূজায় পুরোহিতের কোনো দরকার নেই, তারা নিজেরাই পুরোহিত। এ পূজার মন্ত্রও কিছু নেই। কেবল কতকগুলি ছড়া—এর প্রায় সবগুলিই তাদের নিজেদেরই তৈরী। এর ভিতর একাধারে তাদের সাংসারিক খবরাখবরের কাহিনী, রাধা-কৃষ্ণ, হর-গৌরীর কাহিনী সব কিছুই পাওয়া যায়।