- বইয়ের নামঃ বাংলার পল্লীগীতি
- লেখকের নামঃ চিত্তরঞ্জন দেব
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১.১৪.০১ ব্রত অনুষ্ঠান
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান
বাংলার লোক-সংগীত তথা লোকসাহিত্যে বাংলার মহিলাদের দান যে নেহাৎ নগণ্য নয় এ কথা আমরা একাধিকবার বলেছি, এবং তার যথাযথ প্রমাণও দেবার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। একথা বলা নিতান্তই অতিরিক্ত বলে মনে হতে পারে যে বাংলায় প্রচলিত অধিকাংশ লৌকিক ব্রত অনুষ্ঠানের “কথা” ও তৎসম্পর্কিত ছড়া কিংবা গানগুলির প্রায় সবটাই বাংলার পুরনারীদের দান। এই সব ব্রতকথা, ছড়া ও গানের মাধ্যমে একদিকে যেমনি পাই সামাজিক খবরাখবর অন্যদিকে মহিলাদের কাব্য প্রতিভারও তারিফ না করে কোনো উপায় নেই।
এক কথায় বার মাসে তের পার্বণের দেশ এই বাংলায় এমন মাস খুব কমই আছে যে-মাসে একটা না একটা ব্রত বা অনুষ্ঠান নেই। কাজেই আমরা এই পরিচ্ছেদে মাস ভেদে ব্রত কথার বিবরণ অতি সংক্ষেপে কিছু কিছু দিয়েই “ধর্ম অনুষ্ঠান প্রসঙ্গ শেষ করব।
১.১৪.০২ কুমারী ব্রত বা শিবপূজা
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – কুমারী ব্রত বা শিবপূজা
একদিকে চৈত্র উৎসব শেষ হল চৈত্র সংক্রান্তির দিনে, অন্যদিকে ঘরে ঘরে শুরু হল কুমারী ব্রত। চৈত্র উৎসব যেমন শৈবানুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়, তেমনি কুমারী মেয়েদের বৈশাখের কুমারী ব্রতও শিব পূজা ছাড়া আর কিছু নয়। পতি হিসাবে শিব হল মেয়েদের আদর্শ। পুরাণে এ সম্পর্কে বিলক্ষণ নজির আছে, হয়ত এ কারণেই বাংলার মেয়েরা কৈশোর থেকেই শিব পূজা করতে শুরু করে। এ শিব পূজায় পুরোহিতের কোনো দরকার নেই। সংস্কৃতের কঠিন শ্লোকও উচ্চারণ করবার কোনো প্রয়োজন হয় না। তারা নিজেদেরই তৈরী ছড়া আউড়ে কখনও বা সমস্বরে সুর করে ছড়া বলে যায়। চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন খুব ভোরে উঠে মেয়েরা বেলে মাটি দিয়ে ছোট ছোট শিব মূর্তি তৈরী করে। পরে সকলের শিবমূর্তি একত্রে বসিয়ে, আবার কখনও ব্রতী একা থাকলে শুধুমাত্র তার নিজের শিবমূর্তিটি তামার টাটের উপর বসিয়ে তাঁর সামনে ভোগ দেয় ফলমূল, আলোচালের নৈবেদ্য, জ্বালিয়ে দেয় ধূপদীপ, পরে শুরু করে শিবকে স্নান করাতে।
এই স্নানের সময়ো মন্ত্র আছে; তবে এ মন্ত্র তাদের নিজস্ব বানানো মন্ত্র। তারা ডান হাতে ধরে ঘটি কা কমণ্ডলুর মাথা, বাঁ হাতে স্পর্শ করে ডান হাতের কনুই, পরে বলতে থাকে :
শিল শিলাটন শিলে বাটন
শিল অঝ্ঝর ঝরে
স্বর্গ হতে বলেন মহাদেব
“গৌরী কি বর্ত করে?”
নড়ে আশা নড়ে পাশ নড়ে সিংহাসন
হর গৌরী কোলে করে গৌরী আরাধণ।।
এরপরে প্রণাম মন্ত্র, তাও তাদেরই তৈরি ছড়া :
আকন্দ বিল্বপত্র আর গঙ্গাজল
এই পেয়ে তুষ্ট হোন ভোলা মহেশ্বর।।
এইভাবে তারা তাদের ব্রত সমাপন করে সেদিনের মতো চলে যায় যে যার কাজে; গোটা বৈশাখ মাস ধরে এইভাবে শিবপূজা করে সংক্রান্তির দিন করে উদযাপন।
১.১৪.০৪ হরির চরণ
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – হরির চরণ
বৈশাখ মাসকে এক কথায় বলা যায় পুণ্য মাস। এই মাসে যে কত রকমের ব্রত নিয়মের কথা শুনতে পাওয়া যায় তার আর ইয়াত্তা নেই। অঞ্চল ভেদে একই ব্রত বিভিন্ন নামে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। অনেকগুলি ব্রত আছে যেগুলি পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে উভয় স্থানেই প্রচলিত, ছড়ার ভিতরকার পার্থক্যও খুব সামান্যই দেখা যায়। ‘হরির চরণ’ ব্রতটি সেই শ্রেণীর। এতেও ঠিক বৈশাখ মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, কুমারী মেয়েদের দেখা যায় পিতলের থালায় বা বাটায় চন্দন দিয়ে এক জোড়া পা আঁকতে। এই পদযুগলই হল শ্রীহরির পাদপদ্ম। বালিকারা সেই থালার উপর একটি করে ফুল ফেলে দিয়ে মন্ত্র পড়তে থাকে :—
হরির চরণ, হরির পা, হরি বলেন ‘মা গো মা,’
কোন্ ভাগ্যবতী পূজে মা?
সে ভাগ্যবতী কী চায়?
আপনাকে সুন্দর চায়, রাজ রাজেশ্বর স্বামী চায়,
গিরিরাজ বাপ চায়, দশরথের মত শ্বশুর চায়,
মেনকার মত মা চায়, দুর্গার মত আদর চায়,
বসুমতীর মত ক্ষমা চায়, দরবার আলো বেটা চায়।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতগণ নিশ্চয় বলবেন, শিশুদের মনে প্রথম থেকেই শ্বশুর, শ্বাশুড়ী ও শ্বশুরবাড়ির কথা ঢুকিয়ে দেওয়া কেন? আমরা এ কথার জবাবে শুধু বলব, বাঙালী সব সময়েই তাদের মেয়েদের দেখাতে চেয়েছে কল্যাণময়ী মাতৃরূপে। তাই শিশু বয়স থেকেই তাদের প্রার্থনা করতে শেখায় :—
হবে পুত্র মরবে না,
পৃথিবীতে এক ফোঁটা চোখের জল পড়বে না।
পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে, মরণ যেন হয় গঙ্গার জলে।
১.১৪.০৫ পুণ্যি পুকুর
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – পুণ্যি পুকুর
‘পুণ্যি পুকুর’ ব্রত পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের উভয় অঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। ছড়াও প্রায় একই রকমের, তবু আমরা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত একটি ‘পুণ্যি পুকুর’ ব্রতের ছড়াই আপনাদের আকছে তুলে ধরব। বৈশাখ মাসের প্রায় সবগুলি ব্রতই কুমারী ব্রত না হলেও এর প্রত্যেকটি ছড়াতেই লক্ষ্য করবেন এর ভিতর মেয়েরা সব সময়ই চায় একদিকে পিতৃকুলের অপরদিকে শ্বশুর কুলের মঙ্গল। শৈশব হতে মেয়েদের এই ভাবে ঘরের এবং পরের মঙ্গল কামনা করবার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হতো বাংলার মেয়েদের। তাই আজও গ্রামাঞ্চলে ঘুরলে শোনা যায় এই সব ব্রত কথা। অতি সংক্ষিপ্ত এসব ব্রত কথা। উঠোনের মাঝখানে ছোট একটি চৌকোণা পুকুর তৈরী করে পহেলা বৈশাখ থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত তার ভিতর প্রতিদন এক ঘটি জল ঢেলে দিয়ে ছড়া বলে, আর একটি করে ফুল ফেলে দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ায় :