এ রকম জীবন কাল্লুর অসহ্য হইয়া উঠিল। সে একদিন ছুটির দিনে বিভার নূতন বাড়ীতে গিয়া গোরী-বাবার সহিত দেখা করিয়া বলিল যে, গোরী-বাবা যদি তাহাকে কোনো নকরি দেয় ত’ তাহার পরবস্তী হয়। বিভা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন কালু, স্কুলের চাকরী ছাড়বি কেন? ওখানেই ত’ বেশ আছিস”
কাল্লুর বুক এই প্রশ্নে যেন ফাটিয়া যাইবার উপক্রম হইল, তাহার অসাগর যেন উথলিয়া পড়িতে চাহিল। পিয়ারী, তুই, এমন পুছলি! এতটুকু দয়া তোর হইল না! এতটুকু বুদ্ধি তোর ঘটে নাই! সে কি বলিবে, কেমন করিয়া বলিবে যে, স্কুলের নোকরি আর তাহার ভালো লাগিতেছে না কেন! কাল্লু মাথা হেঁট করিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।
বিভা আবার জিজ্ঞাসা করিল—“কেন, স্কুলের চাকরী ছাড়বি কেন?”
কাল্লু ধীর স্বরে বলিল—“জী নেহি লাগতা!” এর বেশী সে কি বলিবো প্রাণ তাহার সেখানে থাকিতে চাহিতেছে না, সেখানে তাহার প্রাণ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে!
বিভা বলিল—“আচ্ছা, তুই দাঁড়া, আমি একবার বাবুকে বলে দেখি” বাবুর নামে কাল্লুর রক্ত গরম হইয়া উঠিল। যে শয়তান তাহার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়াছে, ভিক্ষার জন্য হাত পাতিতে হইবে তাহার কাছে! কাল্লু বলিয়া উঠিল—“গোরী-বাবা, হাম নোকর নেহি…” কাল্লু চাহিয়া দেখিল বিভা তখন চলিয়া গিয়াছে।
বিভা গিয়া স্বামীকে বলিল—“ওগো শুনছ, দেখ, আমাদের স্কুলের সেই যে সহিসটা আমার বেয়ারার কাজ করত, সে আমার এখানে কাজ করতে চায় তাকে রাখব? তাকে এতটুকু বেলা থেকে দেখছি, বড় ভালো লোক সো”
বিভার স্বামী সচকিত হইয়া বলিয়া উঠিল—“কে, সেই কালো কুচকুচে শয়তানটা? সে ভালো লোক! তুমি দেখনি তার চোখের চাউনি—যেন কালো বাঘের চোখ! তাকে রেখো না, সে কোন দিন ঘাড় ভেঙে রক্ত খাবে, আমায় খুন করবে!”
বিভা হাসিয়া বলিল—“অনাছিষ্টি ভয় তোমার! সবাই ত’ তোমার মতো সুন্দর হতে পারে না। ভগবান ওকে কালো করেছে তা এখন কি হবো”
বিভার স্বামী ভয়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল—“শুধু কালো রং নয়, তার ঐ ছুরির নখের মতো জ্বলজ্বলে চোখ দুটো যেন একেবারে মর্মে গিয়ে বেঁধে ওকে বাড়ীতে ঠাঁই দেওয়া সে কিছুতেই হবে না।”
বিভা স্বামীর স্বরের দৃঢ়তা দেখিয়া আর কিছু বলিল না। আস্তে আস্তে বাহির হইয়া গিয়া ডাকিল —“কাল্লু!”
কাল্লু আর সেখানে নাই, কাল্লু চলিয়া গিয়াছে।
বিভা মনে করিল, তাহার স্বামীর কথা শুনিতে পাইয়াই কাল্লু বোধ হয় ব্যথিত আহত হইয়া চলিয়া গিয়াছে। বিভাও ইহাতে একটু বেদনা অনুভব করিয়া ক্ষুন্ন হইল। আহা, গরীব বেচারা!
কাল্লু স্কুলে গিয়া কর্মে ইস্তফা দিল। তাহার আলাপীর। বলিল, তুই কাজ ছাড়িয়া করিবি কি? কাল্লু বলিল, সে জুতো সেলাই করিবে ইহা শুনিয়া তাহার সঙ্গীরা স্থির করিল, কাল্লু নিশ্চয় বাউরা হইয়া গিয়াছে, নতুবা কাহারো কি কখনো এমন নোকরী ছাড়িয়া জুতা সেলাই করিবার শখ হয়? তাহারা কত বুঝাইল, কাল্লু কোনো উপদেশই কানে তুলিল না।
কাল্লু বিভার নিকট হইতে যে সিকি-দুয়ানি বখশিশ পাইয়াছিল, তাহাতে কোঁড়া ঝালাইয়া পাটোয়ারকে দিয়া রেশম ও জরি জড়াইয়া গাঁথাইয়া লইয়াছিল। সেই মালাটিকে সে আজ গলায় পরিলা তারপর সেলাই বুরুশের সরঞ্জামের সঙ্গে বিভার-দেওয়া বইখানি থলিতে পুরিয়া থলি কাঁধে উঠাইয়া স্কুল হইতে সে বাহির হইয়া চলিল। পথে তাহার দেখা হইল ভিমরুলের সঙ্গে। একটি ছোট মেয়ে হাসিয়া বলিয়া উঠিল—“বা রে, সহিস আবার সেলাইব্রুশ সেজেছে। লাব্রুশা” কাল্লু একবার তাহাদের দিকে তীব্র দৃষ্টি হানিয়া গেট পার হইয়া পথের জনস্রোতে ভাসিয়া পড়িল।
বিভা হঠাৎ জানালার কাছে গিয়া দেখিল, তাহাদের বাড়ির অপর দিকের ফুটপাতের উপর কাল্লু তাহার জুতা-সেলাইয়ের তোড়জোড় লইয়া বসিয়া আছে। বিভাকে দেখিয়াই তাহার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে হাসিয়া বুঝাইয়া দিল—সে স্কুলের চাকরী ছাড়িয়া দিয়া এই বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে এবং সে বেশ সুখেই আছে। কিন্তু বিভা কেন যেন অকারণে বিষণ্ণ হইয়া উঠিল, সে আর জানালায় দাঁড়াইতে পারিল না।
তারপর হইতে রোজই বিভা দেখে, সকাল-বিকাল দু’বেলাই কাল্লু সেই ঠিক এক জায়গাতেই বসিয়া থাকে রৌদ্র নাই বৃষ্টি নাই সে বসিয়াই থাকে, কোনো দিন তার কামাই হয় না। অতিবৃষ্টির সময়ও সে নড়ে না, জুতার তলায় হাফসোল দিবার চামড়াখানি মাথার উপর তুলিয়া ধরিয়া সে ঠায় বসিয়া বসিয়া ভিজে দারুণ রৌদ্রের সময়ও সে নড়ে না, গামছাখানি মাথার পাগড়ির উপর ঘোমটার মতন করিয়া ঝুলাইয়া দিয়া সে বসিয়া বসিয়া দরদর করিয়া ঘামো বর্ষা ঘনাইয়া আসিলে, সে আনন্দে কাজরীর গান গাহে–
পিয়া গিয়া পরদেশ, লিখত নাহি পাঁতি রে
রোয় রোয় আঁখিয়া ফাটত মেরি ছাতি রে!
উৎসবের দিন সুসজ্জিতা বিভাকে গাড়ী চড়িয়া কোথাও যাইতে দেখিলেও তাহার গান পায়, সে গাহে–
করি উজর শিঙার তু চললু বাজার,
তেরি কাজর নয়না ছাতি তোড়ত হাজার!
তাহার গানে শুধু ছাতি টুটিবারই সংবাদ সে ছুতায়নাতায় প্রকাশ করিতা পথের লোকে এই রসপাগল মুচির কাছে জুতা সেলাই করাইতে করাইতে এমনি সব গান শুনিত–
নৈয়া ঝাঁঝরি, অন পরি মউজ ধারা
বায়ু বহি পূরবৈয়াঁ,
অব কস মিলন ভঁয়ে হু হামারা।।
রহি গো পংথ, পাগর পবনা,
সুনহর ঘুংঘট কাজর-নয়না।
পার করো গোঁসাইয়া।।